জীবনানন্দের হাসির বৈশিষ্ট্য ছিল অন্য রকম। হঠাৎ হেসে উঠতেন খুব জোরে। কী কারণে হাসছেন, তা স্পষ্ট ছিল না। শামসুর রাহমান যখন তাঁর বাসায় তার সঙ্গে দেখা করতে যান কলকাতায় তখনো তিনি জীবনানন্দের হাসি শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন। সে গল্প শামসুর রাহমান বহুবার আমাদের বলেছেন। হঠাৎ কী কারণে হেসে উঠলেন, তা বোঝার আগেই হাসি মিলিয়ে গেল। শামসুর রাহমানের ভাষায়, দুনিয়ার কোনো কিছুর সঙ্গেই সে হাসির কোনো সম্পর্ক নাই। এবং সে হাসির স্থায়িত্বও খুব কম।
জীবনানন্দের হাসি উপভোগের অভিজ্ঞতা শামসুদ্দীনেরও ছিল। তাঁর ভাষায় :
‘জীবনানন্দ বাবুর এই হাসিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবেগকে চেপে রাখতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। ভালো লাগার আবেগকেও। অসংযত জীবনযাপন তো দূরের কথা– রচনাও ছিল সংযমী। হাসির আবেগকেও লুকিয়ে রাখতে চাইতেন তিনি। অনেক সময় দেখা গেছে, যে-হাসির প্রসঙ্গ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, সেইকালে অকস্মাৎ বাঁধভাঙার মতো করে বেরিয়ে পড়েছে তার হাসি। তবু এমন হাসতে তাকে তার বন্ধুবান্ধব ছাড়া কেউ কখনো দেখেনি।
প্রতিবেশী হিসেবে জীবনানন্দকে খুব কাছ থেকে দেখে তাঁর প্রকৃত স্বরূপটি ধরতে পেরেছিলেন শামসুদ্দীন। তিনি বলেছেন,
‘বন্ধু-সংখ্যা তাঁর প্রচুর নয়। অচিন্ত্য বাবু, প্রেমেন বাবু তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বুদ্ধদেব বাবুও শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে খুব।’ শামসুদ্দীন আরও জানান, যারা তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশেছেন তাঁরা তাঁর সত্যিকারের মনটিকে চিনেছেন। নয়তো বাইরে তিনি নির্জনতাপ্রয়াসী, আত্মকেন্দ্রিক, অর্থাৎ ভদ্রতাহীন ভাষায় “অসামাজিক” বলেই পরিচিত ছিলেন। বরিশালের মতো মফস্বল শহরে থেকেও তাঁর মনকে আমি কোনোদিন হাঁপিয়ে উঠতে দেখিনি। নিজের বাড়ি, তাঁর সামনের মাঠ এবং ইংরেজি সাহিত্যের অসংখ্য কাব্য ও কবিতার বই-ই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় সুহৃদ।’
সমবয়সী হলেও বিপুল খ্যাতিমান নজরুলকে জীবনানন্দ সমীহ করতেন। বাংলা কবিতায় তাঁর অতুলনীয় অবদান এবং জাতীয় জীবনে তার ভূমিকার প্রশংসা করতেন। তাঁদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মেলামেশার সুযোগ ঘটেনি। প্রথম দিকে জীবনানন্দ নজরুলের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। শোকসভায় শামসুদ্দীন বলেছিলেন :
‘কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ছিল ঝরা পালক। সুন্দর সাবলীল ছন্দোবদ্ধ কবিতা। নজরুল ও সত্যেন দত্তের কথা মনে পড়িয়ে দেয় সে-সব কবিতা।’
স্মৃতি রোমন্থন করে শামসুদ্দীন তাঁর প্রবন্ধটিতে লিখেছিলেন : “বরিশাল থেকে। তিনি চলে গেলেন কলকাতায় দেশভাগের পরেই। বরিশালে আমরা তার অত্যন্ত কাছাকাছি এসেছিলাম। তিনি আমার বরিশালের বাসায় এসেছেন অনেকদিন। আমাদের ছোটো টিনের ঘরের দোতলায় তাঁকে সাহিত্যের আড্ডায়ও পেয়েছি। একদিন সেই আড্ডায় অচিন্ত্য কুমারকে দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে উঠেছিলেন বলে মনে পড়ছে। মনে তাঁর কোনো ঘোরপ্যাঁচ বা সঙ্কীর্ণতা ছিল না– সহজ সরল, সাদাসিধে এবং নিরহঙ্কার ছিলেন তিনি। আরও ছিলেন বিনয়ী।
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকটি ছিল রাজনৈতিকভাবে অস্থির। জীবিকা উপার্জনে হিমশিম খেয়েছেন জীবনানন্দ। বরিশাল থেকে গিয়ে কলকাতায় থাকতেন ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডে। দৈনিক স্বরাজ পত্রিকার রবিবারের সাময়িকীর সম্পাদনা করতেন কিছুদিন। তখনো শামসুদ্দীন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। জীবনানন্দ একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগও নিয়েছিলেন, সে তথ্য দিয়েছেন তিনি:
‘স্বরাজ বন্ধ হয়ে যাবার পরে একটা মাসিক পত্রিকা প্রকাশের সঙ্কল্প করেছিলেন তিনি, আমি ও নির্মল চট্টোপাধ্যায় মিলে। কিন্তু বিজ্ঞাপন সংগ্রহে তিনজনই অপটু ছিলাম বলে শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলালো না।’
শামসুদ্দীনের সহপাঠী বন্ধু ছিলেন নির্মল চট্টোপাধ্যায়, লেখালেখি করতেন, তবে বেশি দূর যেতে পারেননি কলকাতায় গিয়ে। কলকাতায় গিয়ে বড়িষা ও খড়গপুর কলেজে বছর দুই অল্প বেতনে জীবনানন্দ অধ্যাপনা করেন। কলকাতা থেকে শামসুদ্দীন চলে আসেন ঢাকায়। তাঁর জীবনের অন্যতম ব্রত ছিল হিন্দু মুসলমানের মিলন। কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের নেতাদের নীতি ছিল বিপরীত। কলকাতায় একসঙ্গে হেঁটেছেন, গল্প করেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘দেশভাগের অব্যবহিত পরেই কলকাতার অর্থনৈতিক জীবনে যে আলোড়ন এসে পড়েছিল, তাতে করে বেশি দিন আর সম্পর্ক রাখা চললো না। ঢাকায় আসার পর আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি। গত বছর (১৯৫৩) কালকাতায় বন্ধু নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছিলাম তিনি কোথায় হাওড়া গার্লস কলেজ] অধ্যাপনার কাজ নিয়েছেন। প্রশ্ন করে জেনেছিলাম, আমার খোঁজখবরও তিনি নিতেন নির্মলের কাছ থেকে।’
শোকসভায় শামসুদ্দীন বলেছিলেন : ‘তাঁর খ্যাতি সাহিত্যমহলের চৌকাঠ পেরিয়ে সাধারণ্যে পৌঁছায়নি। কারণ তিনি ছিলেন স্বল্পবাক, চলতেন ভিড় এড়িয়ে, লিখতেন না ঘন ঘন, সভায় হতেন না সভাপতি, না করতেন বক্তৃতা। সবচেয়ে বড় কথা, না ছিলেন তথাকথিতভাবে “ফ্যাসিবাদবিরোধী” বা “প্রগতিশীল”। …কিন্তু তার জন্য, তাঁকে আমি জানতাম বলেই বলতে পারি খেদ করতে দেখিনি কোনোদিন। বরঞ্চ যাদের কাছে তিনি শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন, তাঁরা মুষ্টিমেয় হলেও, তাদের নিয়েই তিনি খুশি থেকেছেন। তিনি নিজেই বলতেন : খ্রিষ্টান পাদরীরা যেমন জনতার হাজার হাজার বর্গমাইলের দিকে তাকিয়ে বাইবেল বিতরণ করেন, শ্ৰেষ্ঠকাব্য সে রকমভাবে বিতরিত হবার জিনিস নয়।