অবশ্য পরে রাজশাহী কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান মুহম্মদ এনামুল হক এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজের বাংলার অধ্যাপক অজিত কুমার গুহকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সরল-সোজা মানুষ গোলাম মোস্তফার কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন সম্ভব ছিল না, তাই তাঁকে বাদ দিয়ে শাইখ শরফুদ্দীনকে সদস্যসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থেকে বোঝা যায়, দুইজন হিন্দু সদস্য গণেশ বসু ও অজিত গুহের পক্ষে ওই ধরনের সাম্প্রদায়িক পরিবেশে কাজ করা সম্ভব ছিল না। তাই তাঁরা অপারগতা প্রকাশ করে কমিটির সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি নেন। ভাষা কমিটি সংখ্যালঘুদের মনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকবে। কারণ তারা দেখছিলেন, বাংলা ভাষা থেকে হিন্দু উপাদান বা লোকায়ত বাংলার উপাদান বাদ দিয়ে ইসলামি বা মুসলমানি উপাদান যোগ করাই হবে ওই কমিটির কাজ। মূল বিষয় বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার অপপ্রয়াস মাত্র। ওই অপপ্রয়াসে শহীদুল্লাহ ও এনামুল হকের মতো পণ্ডিতদের যুক্ত থাকা ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক। গণেশ বসু ও অজিত গুহের মতো তাঁরাও যদি কমিটি থেকে অব্যাহতি চাইতেন, সেটাই হতো উপযুক্ত কাজ। কিন্তু তারা যতটা না বিশ্বাস থেকে তার চেয়ে বেশি বিভ্রান্তি থেকে এবং সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। গণেশ বসু অব্যাহতি নিলে তার জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হরনাথ পালকে নেওয়া হয়।
পূর্ব বাংলার মানুষ চেয়েছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। সেই দিকেই সরকারের প্রাধান্য দেওয়ার কথা। কিন্তু তা না দিয়ে বাঙালির ভাষাকে ইসলামীকরণ, মুসলমানীকরণ, আরবি হরফে বাংলা লেখার সুপারিশ কিংবা রোমান হরফে বাংলা লেখার অপচেষ্টা চালাতে থাকে; যেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাংলা ভাষার সংস্কার করার জন্য।
আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে যেসব বাঙালি লেখক-শিক্ষাবিদ কেন্দ্রীয় সরকারের সুরে সুর মেলান, তাঁদের একজন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন। ১৯৪৯-এর ১৫ মার্চ, তিনি দৈনিক আজাদ-এ প্রকাশিত এক লেখায় বলেন, ‘…আরবি হরফে বাংলা লেখা সম্ভব কি না সে প্রশ্নের আলোচনা আমরা করিব না; কারণ পূর্বেই বলিয়াছি যে, পূর্ব পাকিস্তানে এককালে আরবি হরফের প্রচলন ছিল এবং এখনও এলাকা বিশেষে ইহার প্রচলন রহিয়াছে। আরবি হরফে বাংলা লেখার অসুবিধার কথা যাহারা বলেন, তাহাদের যুক্তির অসাড়তা ইতিহাসই প্রমাণ করিয়া দিয়াছে। সপ্তদশ শতাব্দীর আলাওল যে বাংলা লিখিতেন উহাতে বেশ সংস্কৃত শব্দ ছিল। যদি আলাওলের পক্ষে সেই ভাষা আরবি হরফে লিখিতে কোনো অসুবিধা না হইয়া থাকে তবে এ যুগে নূতন করিয়া অসুবিধা হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নাই। [বশীর আলহেলাল, ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস, বাংলা একাডেমি,১৯৮৫, পৃ. ৬৩৩-৩৪]
সৈয়দ আলাওলের নিজের হাতের লেখা কোনো পাণ্ডুলিপি সাজ্জাদ হোসায়েন কোথাও দেখেছেন কি না তা তিনিই বলতে পারতেন, তবে তিনি বা তারও আগে আবদুল হাকিম এবং ওই সময়ের কবিরা নিশ্চয়ই বাংলা অক্ষরেই লিখেছেন। সেকালে মুসলমান কবিদের কেউ যদি আরবি হরফে বাংলা কবিতা লিখে থাকেন, এবং কেউ কেউ লিখেছেনও, সেটা তিন শ বছর পরে আবার বাংলা ভাষায় চালু করতে হবে, যখন বাংলা সাহিত্য বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি পেয়েছে, তা কোনো সুস্থ বা প্রকৃতিস্থ মানুষের পক্ষে ভাবা সম্ভব নয়। পাকিস্তান একশ্রেণির বাঙালি শিক্ষিত মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত করে দিয়েছিল। অল্পসল্প মাথা খারাপ নয়,বদ্ধ উন্মাদ করে দিয়েছিল একশ্রেণির বাঙালি মুসলমানকে। তবে তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য। সাধারণ মানুষ ওই সব অপতৎপরতাকে ঘৃণা করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন।
আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে ছিলেন যাঁরা, তাঁদের একজন সাংবাদিক সাহিত্যিক মুজিবর রহমান খাঁ। আবুল ফজলের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ১৯৪৯-এর ২ এপ্রিল, মুজিবর রহমান খাঁ বলেন :
‘মোছলেম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলনের দ্বারা আজ আমরা পাকিস্তান অর্জন করিয়াছি। আমাদের স্বাধীন পাকিস্তানের তমদ্দুন আন্দোলন হইবে আমাদের জাতীয় ভাবধারাকে সজীব করিয়া তোলার প্রয়াস। প্রথমত: জাতীয় পাকিস্তানি রাষ্ট্র ইহার অর্থ পাকিস্তানে এক রাষ্ট্রীয় ভাষা, এক রাজনৈতিক বন্ধন ও এক তমদ্দুন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাট ভৌগোলিক ব্যবধান রহিয়াছে; কিন্তু আমাদের পরস্পরের নিকটতম হওয়ার জন্য প্রয়োজন ঐক্য, মিলন, সংহতি এবং তমদ্দুনিক যোগাযোগ। ইহার জন্যই আরবি বর্ণমালা গ্রহণ প্রয়োজন।
‘বাঙ্গলা সাহিত্যে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিবঙ্গের মধ্যে একটি বিরোধ রহিয়াছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও মোছলেম লীগের বিরোধের ন্যায় বাংলাসাহিত্যেও মোছলমান ও হিন্দু সাহিত্যিকগণের মধ্যে একটা বিরোধ রহিয়াছে। …. বাঙ্গলা বর্ণমালা সংস্কৃত বর্ণমালার অপভ্রংশ এবং ইহা বহু ত্রুটিপূর্ণ। এজন্য বহু হিন্দু সাহিত্যিক ও পণ্ডিত বাঙ্গলা বর্ণমালাকে রোমান অক্ষরে রূপান্তরিত করিবার জন্য প্রস্তাব করিয়াছিলেন। সুসাহিত্যিক এবং ভারত সরকারের মন্ত্রী শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি নিজে প্রস্তাব করিয়াছেন বাংলা বর্ণমালাকে হিন্দি বর্ণমালায় রূপান্তরিত করিবার জন্য। যদি বাংলা বর্ণমালা হিন্দি বর্ণমালায় রূপান্তরিত করা সম্ভব হয়, তবে বাংলা বর্ণমালা আরবিতে গ্রহণ করা কষ্টকর হইতে পারে না। …. সেই দিন নিকটবর্তী যেই দিন আরবি বর্ণমালায় বাংলা ভাষা এবং উর্দুর মিশ্রণে একটি মাত্র পাকিস্তানি ভাষার জন্ম হইবে।