পঞ্চাশের দশক ছিল বাঙালি মুসলমানের নতুন গন্তব্যে যাত্রার লক্ষ্যে প্রস্তুতির সময়। তবে সেই প্রস্তুতির সময়টির পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে পারেননি শিক্ষিত মুসলমান। তাঁদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছিল আর ছিল না উপযুক্ত নেতৃত্ব। নেতৃত্বহীন জাতি বিভ্রান্তির গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খায়। বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম আরও মারাত্মক বুদ্ধিবৃত্তিক সততা আরও বেশি প্রয়োজন।
০৩. নতুন রাষ্ট্র : ভাষা সংস্কার কমিটি
পৃথিবীতে কোনো জাতিরাষ্ট্রই এক-জাতি-রাষ্ট্র নয়। এক ভাষাভাষী রাষ্ট্রও নেই বললেই চলে, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি আরব দেশ ছাড়া। ভারতের মতো পাকিস্তানও। ছিল বহুজাতিক রাষ্ট্র। বহু ভাষাভাষী মানুষের রাষ্ট্র। বহু ধর্মের মানুষের দেশ। জাতীয় সংহতি সব দেশেই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। হাজার মাইল দূরে দুই ডানাবিশিষ্ট পাকিস্তানের সংহতির জন্য প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্যের। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি সংহতির জন্য শুধু ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করতে চাইল। জাতীয় সংহতির জন্য ধম কোনো প্রধান উপাদান হতে পারে না।
মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ তাঁর এক রচনায় মওলানা মোহাম্মদ আকরম খার একটি লেখার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তাতে আকরম খাঁ লিখেছেন :
‘সকল দলেই চরমপন্থী আছে। (আমাদের বাঙালি মুসলমান) চরমপন্থীরা বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন, বাঙ্গলা শুধু আমাদের মাতৃভাষা নহে উহা আমাদের জাতীয় ভাষাও বটে।… নেশন বা জাতি সম্বন্ধে মোছলমানদের আদর্শ স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্রই মোছলেম জাতীয়তার বিশেষত্ব এবং মোছলেম জাতির রক্ষাকবচ। এ বিষয়ে আলোচনা করিবার সময় আমাদিগকে বিশেষ করিয়া স্মরণ রাখিতে হইবে যে, মোছলমানের জাতীয়তা বংশ, ব্যবসায় বা দেশগত নহে। মোছলমানের। জাতীয়তা সম্পূর্ণ ধর্মর্গত। বিশ্বের সব মোছলমান মিলিয়া এক অভিন্ন ও অভেদ্য জাতি। কোনো মহাদেশের কোনো দেশের বা কোনো প্রদেশের মোছলমানদিগের দ্বারা কথিত ভাষা সেই দেশের মোছলমানদিগের জাতীয় ভাষা বলিয়া গৃহীত হইতে পারে না। মোছলমানের জাতীয় ভাষা যে আরবি একথা ভুলিলে মোছলমানের সর্বনাশ হইবে। এই আরবি ভাষাই বিশ্ব মোছলমানের মিলনের একমাত্র অবলম্বন।’
[মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা-প্রীতি, ঢাকা,১৯৮০, পৃষ্ঠা. ৬২]
আকরম খাঁর এই বক্তব্য অনেক দিন আগের। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর আগে তিনি তাঁর এক লেখায়, যা মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়েছিল। তখন ছিল অখণ্ড বাংলা ও অখণ্ড ভারত। তিনি জানতেন না যে একদিন পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র হবে এই উপমহাদেশে এবং বাংলা ভাগ হয়ে তার এক অংশ হবে পাকিস্তানের। একটি প্রদেশ এবং আরেক অংশ হবে ভারতের একটি প্রদেশ।
পাকিস্তানের দুই অংশেরই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুদীর্ঘ কালের। এদিকে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেমন অতি প্রাচীন; তেমনি ওদিকে পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ প্রভৃতির সভ্যতা কয়েক হাজার বছরের। এই রাষ্ট্রের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্নে দায়িত্বজ্ঞানহীন তৎপরতা শুরু করে।
১৯৪৯ সালের ৯ মার্চ সরকার ঘোষণা করে ‘ইস্ট বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ কমিটি’-পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি। উদ্দেশ্য, পূর্ব বাংলার মানুষের ভাষার সরলীকরণ, সংস্কার ও প্রমিতকরণের প্রশ্ন বিবেচনা করা এবং বাংলা ভাষাকে নির্দিষ্টভাবে পূর্ব বাংলা এবং সাধারণভাবে পাকিস্তানের মানুষের প্রতিভা ও কৃষ্টির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা। এই কমিটি গঠন ছিল একেবারেই অপ্রয়োজনীয় একটি কাজ। নতুন রাষ্ট্রে অসংখ্য সমস্যা ছিল। সেসব জরুরি সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে বাংলা ভাষা সংস্কারে সরকারের তৎপরতার নিশ্চয়ই বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। পাকিস্তানের মানুষের প্রতিভা ও কৃষ্টি কথাটিতে তা পরিষ্কার। উর্দু, পাঞ্জাবি ও সিল্কি ভাষাও পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশেই প্রচলিত। সেগুলো সংস্কারের জন্য সরকারের মাথাব্যথা ছিল না। বাংলা ভাষা সংস্কারের উদ্বেগ অর্থহীন ছিল না, কারণ তার সঙ্গে জড়িত ছিল রাজনীতি-প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি।
ভাষা সংস্কার কমিটির সভাপতি করা হয়েছিল মুসলিম লীগের নেতা ও আজাদ পত্রিকার মালিক মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে, বাংলা ভাষার বিষয়ে যার কোনো জ্ঞান ছিল না। কমিটির সদস্যসচিব করা হয়েছিল কবি গোলাম মোস্তফাকে, তিনি তখন ছিলেন ফরিদপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি ছিলেন খুব ভালো কবি, কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানে তারও কোনো ব্যুৎপত্তি ছিল না। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মন্ত্রী ও লেখক হাবীবুল্লাহ বাহার, মন্ত্রী এ এম মালিক (একাত্তরে ইয়াহিয়া নিযুক্ত অধিকৃত বাংলাদেশের গভর্নর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (দিনাজপুর) মওলানা আবদুল্লাহ আলবাকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও দৈনিক আজাদ-এর সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, পুলিশের ডিআইজি সৈয়দ আবুল হাসনাত, মোহাম্মদ ইসমাইল, শিক্ষা বিভাগের উপসচিব মীজানুর রহমান, সিলেটের এমসি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এমাজউদ্দিন আহমদ, ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যক্ষ শাইখ শরফুদ্দীন, নওগাঁর ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যাপক আবুল কাসেম মোহাম্মদ আমুদ্দীন, চট্টগ্রাম আলাভিয়া প্রেসের মালিক জুলফিকার আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান গণেশচরণ বসু এবং ঢাকার জমিদার ও সমাজসেবক মোহিনী মোহন দাস। শহীদুল্লাহ ও গণেশ বসু ছাড়া কমিটির কোনো সদস্যের বাংলা ভাষাতত্ত্বে কোনো জ্ঞান ছিল না। তবে তাঁদের যা ছিল, তা হলো বাংলা ভাষাকে ইসলামি রূপ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। বাংলা ভাষা সংস্কারের জন্য গঠিত এই কমিটির সুপারিশ যারা করেছিলেন, তাঁদের আক্কেলের তারিফ করতে হয়।