‘মুসলমান এই সন্দেহটি মনে লইয়া আমাদের ডাকে সাড়া দেয় নাই। আমরা দুই পক্ষ একত্র থাকিলে মোটের উপর লাভের অঙ্ক বেশি হইবে বটে, কিন্তু লাভের অংশ তাহার পক্ষে বেশি হইবে কিনা, মুসলমানের সেইটেই বিবেচ্য। অতএব মুসলমানের এ কথা বলা অসঙ্গত নহে যে আমি যদি পৃথক থাকিয়াই বড়ো হইতে পারি তবেই তাহাতে আমার লাভ।’
[রবীন্দ্র রচনাবলী, ত্রয়োদশ খণ্ড, ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ, কলকাতা, পৃ. ১৭৯-৯২]
কংগ্রেসের সুবিধাবাদী ও এক শ্রেণির সাম্প্রদায়িকতাবাদী হিন্দু নেতাদের সঙ্গে যুক্তিবাদী রবীন্দ্রনাথের পার্থক্য এখানেই। তিনি অন্য সম্প্রদায়ের দুর্বলতা ও নিজের সম্প্রদায়ের দোষ দেখতে পেয়েছেন। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে যখন নতুন প্রদেশ হয় ১৯০৫ সালে, শ্রেণিস্বার্থে বিশেষ করে জমিদারি হারানোর শঙ্কায় রবীন্দ্রনাথও তার বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু বছর দেড়েকের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারেন ওই বিরোধিতা করাটা ভুল ছিল। তিনি নতুন প্রদেশবিরোধী আন্দোলন, যার প্রচলিত নাম বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, তা থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতারা নতুন প্রদেশ বাতিল না করা পর্যন্ত আদা নুন খেয়ে লেগে থাকেন। এবং ১৯১১-তে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ বাতিল করতে সরকারকে বাধ্য করেন। উপরের উদ্ধৃত কথাগুলো তখনই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বেঁচে থাকলে এই কথাগুলোই পুনর্বার লিখতেন। তাঁর আয়ের উৎস সব জমিদারিই ছিল পূর্ব বাংলায়। সুতরাং, পূর্ব বাংলা পাকিস্তানে পড়ায় তিনি হতেন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। তখন তাঁর নিজের স্বার্থ ও বাঙালি মুসলমানের স্বার্থ –এই দুইয়ের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তিনি কোনটিকে প্রাধান্য দিতেন, তা নিয়ে অনুমান না করাই ভালো।
পূর্ব বাংলায় আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের বাধ্য করেছেন মহাসভা ও কংগ্রেস নেতারা। বাঙালি মুসলমান কস্মিনকালেও, ১৯৪০ সালের আগে, আলাদা রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করেনি। শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা হিন্দুদের সঙ্গে একত্রে পাশাপাশি বাস করেছে এবং অনাগত শত শত বছরও তারা একসঙ্গেই থাকতে চেয়েছে। তারা যা চেয়েছে তা হলো তাদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা। এই দুটোর কোনোটাই প্রতিপক্ষ থেকে না পাওয়ায় তারা দাবি তোলে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার, যে রাষ্ট্রে তারাই হবে তাদের ভাগ্যবিধাতা। তারই পরিণাম পাকিস্তান এবং তারপর বাংলাদেশ।
০২. পূর্ব বাংলার পুনর্জন্ম
পূর্ব বাংলা, যাকে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর বলা হতো পূর্ব পাকিস্তান, ১৯৪৭ এর আগস্টে শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করে। শূন্য হাত কথাটি কথার কথা নয়। ঢাকা হলো পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী। পুরোনো শহর, কিন্তু দুই শতাব্দীর অবহেলায় তা প্রাণহীন। সমস্ত বাংলার সব সম্পদ গিয়ে জমা হতো কলকাতায়। কলকাতার শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে গিয়ে ঢাকাকে করা হয় হতশ্রী। প্রাণ বলতে ঢাকায় ছিল শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে সেই নীলক্ষেত রমনা এলাকায়, যা মূল ঢাকা শহর থেকে সামান্য দূরে এবং এক পাশে, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা হতো। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা হতো। বড় বড় পণ্ডিতেরা বাস করতেন নীলক্ষেত ও রমনায়।
ঢাকা আজ পত্রপত্রিকায় সয়লাব। শত শত দৈনিক, সাপ্তাহিক প্রকাশিত হচ্ছে। ষাটের দশক থেকেই পত্রপত্রিকা প্রকাশের প্রবণতা দেখা যায়। ষাটের দশকেই ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতো কয়েকটি উন্নতমানের বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক। দৈনিক পাকিস্তান, পূর্বদেশ প্রভৃতি এবং দ্য পাকিস্তান অবজারভার, মর্নিং নিউজ এর মান কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, দ্য স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার পত্রিকা বা হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এর চেয়ে কম ছিল, তা বলা যাবে না। কিন্তু সেই ঢাকাতে ১৯৪৭ সালে কোনো দৈনিক পত্রিকা ছিল না। একটি বাংলা দৈনিকও ছিল না, একটি ইংরেজি দৈনিকও নয়। ঢাকাবাসীর তথা পূর্ব বাংলার মানুষের পত্রিকা পাঠের শখ মেটাতে হতো কলকাতার কাগজ দিয়ে। অর্থাৎ কলকাতার পত্রিকার বাজার ছিল ঢাকা ও বাংলাদেশ। কলকাতার দৈনিক কাগজ দিনেরটি দিনেই ঢাকায় ও চট্টগ্রামে পৌঁছাত। অবশ্য বিকেল হয়ে যেত। কলকাতা থেকে কাগজ ঢাকায় আসত কিছু বিমানে, বেশির ভাগই আসত ট্রেনে ও স্টিমারে।
সাতচল্লিশের পর পূর্ব বাংলার প্রথম দৈনিক প্রকাশিত হয় ঢাকা নয় চট্টগ্রাম। থেকে। তার নাম দৈনিক পাকিস্তান। স্বত্বাধিকারী ছিলেন কাজী বজলুল হক। সম্পাদক ছিলেন কবি আবদুস সালাম। সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক কাজী আফসারউদ্দীন আহমদ। দৈনিক পাকিস্তান ছিল চার পাতার পত্রিকা, কোনো দিন ছয় পাতা। আমাদের বাড়িতে তার কিছু কপি ছিল। এখনো দু-চার কপি সম্ভবত আছে। এই তো চল্লিশের দশকের পূর্ব বাংলার অবস্থা। যেখানে পত্রপত্রিকাই নেই, সেখানে উন্নত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা কীভাবে হবে?
পাকিস্তান যখন স্বাধীনতা লাভ করে, তখন ঢাকায় মাত্র একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। কাগজটি অনেক পুরোনো। তার নাম দ্য ইস্ট বেঙ্গল টাইমস। খুব মানসম্মত সাপ্তাহিক নয়। সামান্যই ছাপা হতো। ঢাকার মানুষও ওটি না পড়ে কলকাতার কাগজই বেশি পড়তেন। ১৯৪৭-এর পরে অনেক শিক্ষিত ও বিত্তবান হিন্দুর মতো দ্য ইস্ট বেঙ্গল টাইমসের মালিকও কলকাতা চলে যান। তবে পত্রিকাটি চালু রেখে যান। দায়িত্ব দিয়ে যান তাঁর ছেলে ও ছেলের স্ত্রীকে। ডিক্লারেশন পরিবর্তন করে নতুন সম্পাদক হলেন তাঁর পুত্রবধূ কল্যাণী গুহ।