যা হোক, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচার বিভাগের পত্রিকা হলেও মাহে নও-এর মান ছিল উঁচু। সে সময় আধুনিক লেখকের সংখ্যাও ছিল কম। অল্প কিছু প্রপাগান্ডামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ থাকত বটে, মাহে নওর অধিকাংশ লেখাই ছিল উন্নত মানের। বিশেষ করে, ১৯৫২-তে যখন কবি ও প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির মাহে নও-এর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন থেকে মাহে নও বাংলা ভাষার একটি প্রথম শ্রেণির সাহিত্যপত্রিকা হিসেবেই প্রকাশিত হতে থাকে। উন্নতমানের কাগজে ছাপা হতো নির্ভুল। পত্রিকাটি ছিল সচিত্র। মুসলমান শিল্পীদের আঁকা পেইন্টিং থাকত দু-চারটি প্রতিটি সংখ্যায়। একেবারে মাসের প্রথম দিনই মাহে নও স্টলে পাওয়া যেত। মাহে। নও-এর অনেক বহুরঙা প্রচ্ছদ করেছেন জয়নুল আবেদিন। পাকিস্তান না হলে তিনি বা তাঁর মতো মুসলমান শিল্পীরা কলকাতায় এই সুযোগ পেতেন না।
দীর্ঘদিন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মাহে নও সম্পাদনা করেছেন আবদুল কাদির। কবি হিসেবেই ছিল তাঁর খ্যাতি। পরে খ্যাতি অর্জন করেন গবেষক হিসেবে।
আবদুল কাদির যখন ঢাকা কলেজের ছাত্র, তখন তিনি মুসলিম সাহিত্য সমাজ’র আবুল হুসেন, কাজী আবদুল অদুদ, কাজী আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ প্রগতিশীল লেখকের সংস্পর্শে আসেন। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিচিতি পান। ওই সময় কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং তার একজন প্রীতিভাজনে পরিণত হন। কবিতা লিখতেন এবং গদ্যচর্চাও করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ বিএ ক্লাসের ছাত্র থাকা অবস্থায় মুসলিম হলের ম্যাগাজিন সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর পড়ালেখা অসমাপ্ত রেখে সাহিত্যচর্চার নেশায় কলকাতা যান এবং মুহম্মদ নাসিরউদ্দিনের সওগাত যোগ দেন সহ-সম্পাদক হিসেবে। সাহিত্য-সাময়িকী সম্পাদনায় তাঁর আগ্রহ ছিল তরুণ বয়স থেকেই। ১৯৩৭ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্যকাগজ জয়তী। সেটি ছিল একটি প্রগতিশীল সাহিত্য-সাময়িকী। প্রতিষ্ঠিত লেখকেরা তাতে লিখতেন। নজরুল ইসলাম ও আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ এ তিনি সাময়িকী বিভাগে কিছুদিন কাজ করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। কবি হিসেবে তখন তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর ছন্দজ্ঞান অতি প্রখর। এ জন্যে তাঁকে একসময় বলা হতো ‘ছান্দসিক কবি’। পত্রিকা সম্পাদনা ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে তাঁর কাব্যচর্চা ব্যাহত হয়েছে।
সম্পাদক হিসেবে আবদুল কাদিরের নিষ্ঠা ও দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনার অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর দীর্ঘকালের। তিনি মুসলিম সাহিত্যসমাজের মুখপত্র, শিখা সম্পাদনা করেছেন বিশের দশকে। সম্পাদক হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই কঠোর। আবদুল কাদিরের পর তারই সহকারী কবি তালিম হোসেন মাহে নও-এর সম্পাদক হন। তিনিও দক্ষ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর। সহকারী ছিলেন প্রাবন্ধিক শাহাবুদ্দিন আহমদ।
শুধু সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনানয়, আবদুল কাদির গ্রন্থ সম্পাদনায়ও ছিলেন খুবই নিষ্ঠাবান। নজরুল রচনাবলী সম্পাদনা তাঁর হাত দিয়েই শুরু। তাঁর সহযোগিতা ছাড়া নজরুল রচনাবলী সংগ্রহ করা কঠিন হতে বাংলাভাগের পর। নজরুল ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন বেগম রোকেয়া রচনাবলী, ইসমাইল হোসেন শিরাজী রচনাবলী, লুৎফর রহমান রচনাবলী, ইয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলী এবং আবুল হুসেন রচনাবলী। এই সম্পাদনার কাজটি যে বাংলা সাহিত্যের কত উপকার করেছে, তা যে কেউ উপলব্ধি করবেন।
একটি কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার। আজ নজরুলকে নিয়ে নানা রকম গবেষণা হচ্ছে। আবদুল কাদির নজরুলের লেখা সংগ্রহ ও সম্পাদনা না করলে নজরুল গবেষণা পরবর্তী গবেষকদের জন্য দুরূহ হতো। এই প্রসঙ্গে তালিম হোসেনের নামটি না নিলে ঘোরতর অন্যায় হবে। তাঁর সম্পাদিত নজরুল একাডেমী পত্রিকা নজরুল গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। প্রত্যেক নজরুলগবেষক আবদুল কাদির এবং তালিম হোসেনের কাছে অপরিশোধ্য ঋণের দায়ে আবদ্ধ। নজরুলচর্চায় নজরুল একাডেমীর ভূমিকা তুলনাহীন।
ষাটের দশকে আবদুল কাদির কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রকাশনা কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁর পরিচালক ছিলেন মুহম্মদ এনামুল হক। তার অফিস ছিল গ্রিন রোডে (ঢাকা) এক বাড়িতে। আমরা যেতাম তার অফিসে, দেখতাম তিনি সারাক্ষণ কাজ করছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। তাঁর কাছে জানা যেত তিরিশ ও চল্লিশের দশকের বহুগুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
প্রচুর পড়াশোনা করতেন আবদুল কাদির। শেষ করলেও পড়াশোনা ছাড়া তিনি সময় নষ্ট করতেন না। স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে তিনি মাঝে মাঝে নিউ মার্কেটে আসতেন। বইপাড়ার কোনো বইয়ের দোকানে বসে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। তার থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে শিখেছি প্রচুর। বহু পুরোনো সাহিত্যকর্ম তাঁর কাছে ছিল। সেগুলো দেখতে চাইলে বলতেন, টাকা ছাড়া এসব কাউকে আমি দেব না। এদিক থেকে আবদুল কাদির সঠিক ছিলেন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাঁর সম্পাদিত মাহে নও ছিল পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে নিয়মিত বাংলা সাময়িকী। এটি পূর্ব বাংলার প্রথম পত্রিকা, যা লেখককে সম্মানী দিত। সেকালে ২০-২৫ টাকা সম্মানী কম নয়। দুই মণ চাল কিংবা চার আনা সোনা অথবা ১২-১৩ ভরি রুপার দাম।
১০. নওবাহার
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে চল্লিশের দশক পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের আত্মপ্রকাশের দরজা ছিল সংকীর্ণ। কলকাতার হিন্দুদের পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে মুসলমান লেখকদের লেখা ছাপা হতো না। মুসলমানদের দুটি প্রধান সাহিত্য পত্রিকা ছিল মোহাম্মদ আকরম খাঁর মোহাম্মদী এবং মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের সওগাত। আধুনিক মুসলমান লেখকদের ভরসা ছিল মোহাম্মদী ও সওগাত। পত্রিকা দুটি ছিল মানসম্মত, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সাময়িকীগুলোর প্রায় সমপর্যায়ের। খুব উঁচু মানের লেখা যেমন থাকত, তেমনি নতুন অনেক লেখকের কাঁচা রচনাও থাকত। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের কিছুটা দুর্বল লেখাও প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার দায়িত্ব নতুন লেখক তৈরি করা। খুব দুর্বল যারা তারা অবলীলায় ঝরে পড়ে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, ফররুখ আহমদ, গোলাম কুদ্দুস, আহসান হাবীব, রশীদ করীম প্রমুখ নতুন প্রজন্মের কবি ও কথাশিল্পীর লেখা সওগাত, মোহাম্মদীই ধারণ করেছে। মোহাম্মদী ছিল প্রধানত রক্ষণশীল, অনেকটা প্রতিক্রিয়াশীলও বটে; কিন্তু সওগাত ছিল প্রগতিশীল। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে বহু নারী কবি-সাহিত্যিক তৈরি করেছে সওগাত। নারী প্রগতির প্রশ্নে সওগাত-এর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিল সওগাত। লেখকদের মধ্যে দুটি দল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল– সওগাত দল ও মোহাম্মদী দল। মাঝে মাঝে দুই দলের মধ্যে কলমযুদ্ধ হতো। সে বিতর্কও মূল্যহীন নয়। তাতে উভয় পক্ষের ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটত। মোহাম্মদীতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ থাকত, সওগাত হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ী সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিল।