পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্য চর্চার একটি সুযোগ আসে। কিন্তু প্রধান কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই ঢাকার চেয়ে করাচি ও লাহোরের দিকে ছোটাকেই আত্ম-উন্নতির উপায় বলে মনে করেন। একটি প্রদেশের মানুষের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি যতটা আনুগত্য প্রদর্শন করা উচিত, তারা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আনুগত্য দেখান। অনেকের আচরণে প্রকাশ পায় দাস্য মনোভাবের।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ও উদ্যোগে যে মাসিক সাহিত্যপত্রিকাটি প্রকাশিত হয় তার নাম মাহে নও। সাময়িকীটির প্রথম সংখ্যা বের হয় এপ্রিল ১৯৪৯ সালে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দেড় বছর পর। প্রতিষ্ঠাকালে এর সম্পাদক ছিলেন আবদুর রশিদ নামের কেউ। মাহে নও-এর প্রধান কার্যালয় ছিল করাচি। মাহে নও নামে উর্দু মাসিকও ছিল। বাংলা মাহে নও-এর কার্যালয় ছিল ঢাকায়। সদ্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্রে সরকারি অর্থে একটি সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশের উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়।
মাহে নও-এর প্রথম সংখ্যায় ‘আমাদের কথা’ শীর্ষক সম্পাদকীয় থেকে জানা যায় :
‘… মামুলি প্রপাগাণ্ডা ইহার উদ্দেশ্য নহে। ইহার আদর্শ পাকিস্তানের তাহজীব তামাদুন। ইহার উদ্দেশ্য দেশের প্রধান সাহিত্যিকদিগকে কদর দেয়া ও নয়া আজাদীর আবহাওয়ায় পরিপুষ্ট নবীন লেখক-লেখিকা সৃষ্টি করা। …. মাশরেকী ও মাগরেবী পাকিস্তানের মধ্যে বিরাট ব্যবধান দূরত্বের মাপকাঠিতে। আদর্শ ও ভাবরাজ্যে কোনো ব্যবধান আছে বলিয়া আজ আর মনে করা যায় না। তাই একাংশের চিন্তাধারা অপর অংশে পরিবেশন করিতে হইবে।
সরকারি পত্রিকায় অবশ্যই সরকারি নীতিরই প্রতিফলন ঘটবে। দেশের দুই অংশের মধ্যে সংহতির সৃষ্টি হোক –সে কামনা থাকাও খুবই স্বাভাবিক। মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে মুসলিম সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য গুরুত্ব পাবে, সেটাও প্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাঙালির যে হাজার বছরের হিন্দু-মুসলমানের সমন্বিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে, তাকে অবহেলা করা আত্মহত্যার শামিল। বাংলাদেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই জানত পাকিস্তানের দুটি অংশ– পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব বাংলার কেউই পূর্ব পাকিস্তানকে ‘মাশরেকি’ পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘মাগরেবি’ পাকিস্তান বলত না। এই শব্দ দুটি ছিল ৯৯ ভাগ বাঙালির কাছে অপরিচিত।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই অগণতান্ত্রিক মনোভাব থেকে শাসকেরা ঘোষণা দেন, দেশের ৫৬ ভাগ মানুষের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে। ওই স্বৈরাচারী ঘোষণার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করেননি, প্রতিবাদ প্রথমে করেছেন প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েটের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতিমান কবি-লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা সরকারি সুবিধা ও নেকনজর হারানোর ঝুঁকি নেননি।
চল্লিশের দশক পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান লেখকেরা মানসম্পন্ন বিশুদ্ধ বাংলায় সাহিত্যচর্চা করেছেন। কেউ কেউ আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন তাঁদের কবিতায়, কিন্তু তা সাধারণ মুসলমান পাঠকদেরও প্রশ্রয় পায়নি। মুসলমান লেখকদের গদ্যে– গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধে– আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার বিরল। কিন্তু সাতচল্লিশের পরে গায়ের জোরে আরবি-উর্দুশব্দ ব্যবহারের প্রবণতা দেখা দেয়। মাহে নও-এর সম্পাদকীয়তে ইংরেজি কালচার অর্থে সংস্কৃতি না লিখে লেখা হলো ‘তাহজিব তামান’। এই পদ দুটির অর্থ শিক্ষিত বাঙালির কাছেও পরিষ্কার নয়। পূর্ববঙ্গকে নতুন নাম পূর্ব পাকিস্তান’ বললেও (সরকারি কাগজপত্রেও পূর্ববঙ্গ সরকার বলা হতো) একজন মানুষও মাশরেকি পাকিস্তান বলত না। স্বাধীনতা অর্থে আজাদি মেনে নেওয়া যায়। যা হোক, একটি মানসম্মত সাহিত্যপত্রিকার প্রয়োজন ছিল। কারণ, তখন ঢাকায় কোনো উন্নতমানের নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা ছিল না। কলকাতার হিন্দুদের পত্রিকায় মুসলমান লেখকেরা স্থান পেতেন না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি মুসলমান লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সমর্থনের সেটাও ছিল একটি কারণ।
কেন্দ্রীয় সরকার মাহে নও নামে উর্দু ও বাংলা সাময়িকী প্রকাশ না করে, যা করতে পারত তা হলো, উর্দুটির নাম মাহে নও এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা মাসিকটির বাংলা শব্দে নামকরণ। তা জাতীয় সংহতির পথে কোনো বাধা হতো না, মাহে নও-এর বাংলা নামকরণ হতে পারেনি দাস্যমনোবৃত্তিসম্পন্ন বাঙালি লেখকদের ব্যক্তিত্বহীনতার কারণে। তারা শুরুতে নিজের থেকেই পশ্চিমাদের প্রভুত্ব মেনে নেন।
মাহে নও-এর প্রথম সংখ্যায় যাদের যেসব লেখা ছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : শওকত ওসমানের গল্প (প্রথম প্রণতি), আশরাফ উজ্জামানের গল্প (আলেয়ার আলো), বেনজীর আহমদের কবিতা (দিগন্ত), আশরাফ সিদ্দিকীর কবিতা (সন্ধ্যার পাখি) এবং হাবীবুল্লাহ বাহারের প্রবন্ধ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, উর্দুভাষী মুখ্যমন্ত্রী স্যার খাজা নাজিমুদ্দীনের একটি প্রবন্ধ ছিল, যার শিরোনাম ‘কায়েদে আজম রহমতুল্লাহ আলাইহে’। রহমতুল্লাহ আলাইহে কথাটির আক্ষরিক অর্থ আল্লাহর রহমত তাঁর ওপর বর্ষিত হোক। কিন্তু সাধারণ রেওয়াজ বা ভাবার্থ হলো এই সম্মান শুধু পয়গম্বর ও পীর-আউলিয়াদের সম্পর্কে প্রযোজ্য। রাজনৈতিক নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পর্কে এ অভিধা একেবারেই অপপ্রয়োেগ ও স্রেফ স্তাবকতা। জিন্নাহকে চল্লিশের দশকে কোনো কোনো লীগপন্থী পত্রিকা ‘আমিরে মিল্লাত’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছে। উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলমানের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে জিন্নাহকে ‘কায়েদে আজম’ সম্বোধন করা হতো। মহাত্মা গান্ধীও তাঁকে কায়েদে আজম সম্বোধন করেছেন। তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাঁর স্তাবকের সংখ্যা পূর্ববঙ্গে সীমা ছাড়িয়ে যায়। তাঁর নিবেদিত প্রশস্তিমূলক কবিতা, প্রবন্ধ, নাটকের পরিমাণ বিপুল। লেখালেখির বিষয়বস্তু হিসেবে অবশ্যই তিনি গুরুত্বপূর্ণ, তা না হলে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা যশোবন্ত সিনহা তাঁকে নিয়ে বড় বই লিখতেন না। সুকান্ত ভট্টাচার্যও জিন্নাহকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা।