মুক্তিযুদ্ধের দেড়-দুই বছর আগে মুস্তাফা নূরুল ইসলামের মুসলিম বাংলা সাহিত্য (১৯৬৮), আনিসুজ্জামানের মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৮) এবং মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৮) প্রকাশিত ও পুরস্কৃত হয়। যদি পাকিস্তান টিকে যেত ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় না ঘটত, তাহলে এই সব বইয়ের সুবাদেই তারা পাকিস্তান সরকার থেকে আরও অনেক পদক পুরস্কার ও সুযোগ-সুবিধা পেতেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ তাদের সহকর্মীদের যাঁরা। পাকিস্তানে আসলে যেমন ছিলেন এবং স্বাধীনতার পরে তারা একই বিশ্বাস ধারণ করে রইলেন তারা শুধু অবহেলার শিকার হলেন না, নানাভাবে অপমানিত হলেন, কেউ কেউ হলেন নিগৃহীত। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সেটা বৈশিষ্ট্য নয়।
পাকিস্তানের এক অংশ ছিল এক মুল্লুকে, আরেক অংশ আরেক দিকে। দুই অংশের মানুষ, ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাপন একেবারেই দুই রকম। বাঙালি সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্রশিল্পীদের রুজি-রোজগারের একটি বড় ক্ষেত্র ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। বাঙালি চিত্রশিল্পীদের ছবির বাজার ছিল করাচি-লাহোর। পূর্ব বাংলায় ছবি কেনার মতো মানুষ ছিলেন অতি অল্প। যে ছবি ঢাকায় বিক্রি হতো খুব বেশি হলে চার-পাঁচ শ টাকায়, সেটাই ওখানকার বড়লোকেরা কিনতেন পাঁচ হাজার টাকায়। বাঙালি অনেক কবি উর্দুতে গান লিখেছেন। আমাদের প্রগতিশীল চলচ্চিত্র পরিচালকেরা বাংলায় ছবি করে লাভবান হতে পারেননি, তাঁরা উর্দুতে ছবি বানিয়েছেন। সে ছবির বাজার পাকিস্তানের দুই অংশেই পাওয়া গেছে। এই জাতীয় কাজে কোনো দোষই ছিল না। কিন্তু ষাটের দশকে যে শিল্পী সরকারি খরচে সাত-আটবার মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে গেছেন, উর্দু ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন, তিনিও তাঁর জীবনবৃত্তান্তে এখন উর্দু ছবিগুলোর উল্লেখ করেন না। পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে বিশ্বভ্রমণ করেছেন, সে কথা তো স্বীকারই করতে চান না। এসব খুব বড় রকমের হীনম্মন্যতা।
ষাটের দশকটা অনেকের জীবনেই ছিল স্বর্ণকাল। তাঁরা সব পেয়েছেন সে সময়। বিশেষ অন্যায়ভাবে পাননি। প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবেই পেয়েছেন। তাঁদের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো সে সময়েরই। ৭২-এ আমাদের একজন শীর্ষ চিত্রশিল্পী বললেন, স্বাধীনতার আগে ছবিই আঁকতে পারতাম না, আমি এখন মুক্তমনে ছবি আঁকতে পারি। অথচ তার সব উল্লেখযোগ্য কাজই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের। আমি তখন তাঁর ওই নিরর্থক বক্তব্যের সমালোচনা করে ইত্তেফাঁক-এ লিখেছিলাম।
কোনো জাতিই সত্যকে আড়াল করে মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সে চেষ্টা করলে সে জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে। মানুষ মাত্রেই ভুলভ্রান্তি ও দুর্বলতার ঊর্ধ্বে নয়। বাস্তবতাকেও অস্বীকার করা যায় না। বাঙালি মুসলমানের প্রতিভাবান অংশটি নানা বিভ্রান্তিতে তাঁদের শক্তির অপচয় করেছেন। তারা ভুল করেছেন ব্রিটিশ আমলে, তারা ভুল ও বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলেন পাকিস্তানি আমলে, এবং বেদনার বিষয়, তারা ভুল ও বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশেও। বুদ্ধিবৃত্তির সততা ছাড়া কোনো জাতি স্থায়িত্বশীল উন্নতি করতে পারে না। সত্যের সাধনা ছাড়া জাতির কল্যাণ হয় না। এখনো সময় আছে, যদি বাঙালিদের নতুন প্রজন্ম তাদের পূর্বজদের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়, তাহলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, তা না হলে বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাঙালির কোনো স্থান থাকবে না। পদানত থাকতে হবে বহু বছর।
০৯. মাহে নও ও আবদুল কাদির
শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানকে চেনা কঠিন। সে কোন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোন রূপ ধারণ করবে, তা বিধাতার পক্ষেও বলা অসম্ভব। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি মুসলমান কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এমন এক বুদ্ধিবিভ্রাট দেখা দেয়, যা কোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ও সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।
পাকিস্তান রাষ্ট্র ও ধর্ম ইসলামকে যদি মুসলিম লীগের শাসক ও নেতাই শুধু একাকার করে ফেলতেন, তা হতো এক কথা; কিন্তু কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহ ও তৎপরতা ছিল আরও বেশি। প্রায় সব খ্যাতিমান কবি লেখকই পাকিস্তানবাদে এবং ‘পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে’ আপ্লুত হয়ে পড়েন। জাতীয়তায় তাঁরা যে বাঙালি, তা বেমালুম ভুলে যান বা অস্বীকার করেন। নাগরিকত্ব ও জাতীয়তা দুই জিনিস তা গুলিয়ে ফেলেন।
১৯৭২-এর জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশের মূলধারার কবি-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা সমস্বরে বলতে থাকেন যে তাঁরা ‘৪৭ থেকে ‘৭১ পর্যন্ত একটি মারাত্মক অধ্যায় পেরিয়ে এসেছেন। জাতির জীবনে শুধু নয়, তাঁদের নিজেদের জীবনে তা ছিল এক ‘দুঃসময়’। সে এক দুঃস্বপ্নের কাল। কেউ কেউ ওই সময়কে তুলনা করেছেন ‘জাহান্নাম’-এর সঙ্গে। জাহান্নাম হলো সবচেয়ে ভয়ংকর নরক। কিন্তু পরিহাসের বিষয় এই যে, যাদের জন্ম ১৯৩০-এর দশকে, তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই শিক্ষাজীবন শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সম্ভবপর সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত ছিলেন না। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। তাঁদের যথারীতি পদোন্নতি হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের নগর-বন্দরে ঘুরে অপার আনন্দ পেয়েছেন। অর্থাৎ, জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। এবং তা করেছেন প্রধানত সামরিক শাসনের মধ্যে।