পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি রাষ্ট্রকে ইসলামীকরণে বদ্ধপরিকর ছিলেন। কালচার অর্থে সংস্কৃতি শব্দটি তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না, তাঁরা চাইতেন তার পরিবর্তে তাহজিব বা তমদ্দুন শব্দ দুটি ব্যবহার করতে। আমরা একসময় বলতাম পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, কিন্তু ষাটের দশকে দেখা গেল ওটা যথেষ্ট নয়, বলা শুরু হলো ‘পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ’। এই শব্দের মানে কোনো বাঙালি জানেন কি না জানি না, আজও আমার কাছে এই পায়েন্দাবাদের অর্থ অজানা। বাঙালিদের মধ্যে– বিশেষ আর কাউকে বলতে শুনিওনি, শুধু গভর্নর মোনায়েম খান তাঁর বক্তৃতা শেষ করতেন ‘পায়েন্দাবাদ’ বলে। জাতীয় জীবনে এবং সংস্কৃতিতে গায়ের জোর খাটে না।
এক ভাষাভাষী ও এক ধর্মাবলম্বীর রাষ্ট্র সম্ভবত পৃথিবীতে একটিও নেই। পাকিস্তান পর্বে পূর্ব বাংলায় উর্দুভাষী মানুষ কয়েক লাখ ছিলেন। তাঁদের উর্দু দৈনিক পত্রিকাও ছিল। সাপ্তাহিক ও মাসিক উর্দু সাময়িকী তো ছিলই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোতে উর্দু, আরবি বিভাগও ছিল। কিন্তু সাধারণভাবে বাঙালিরা উর্দুর চর্চা করতেন না। বাংলা সাহিত্যের অনেক গল্প-উপন্যাস উর্দুতে তরজমা হয়েছে, অনেক উর্দু গল্প-কবিতা বাংলায় অনূদিত হয়েছে। সেটা স্বাভাবিক। কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর মদদে এবং তাদের খুশি করতে আগবাড়িয়ে বাঙালি শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ বাংলাদেশে উর্দুচর্চার ব্যবস্থা করেছেন। বিশেষ করে, কবি ইকবালকে পূর্ব বাংলায় জনপ্রিয় করতে বিচিত্র উদ্যোগ নেওয়া হতো এবং তাতে বাঙালি শিক্ষাবিদ ও লেখকদের সহযোগিতা ছিল সর্বাত্মক।
একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। নতুন প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের মতো একটি উর্দু ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থাকা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সেখানে ১৯৬৭-তে উপাচার্য আজিজুর রহমান মল্লিকের প্রধান পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি সংস্থা : ‘বাজম-ই-আনজুম’। তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ইকবাল ও পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে গবেষণা ও সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করা। চট্টগ্রামের একটি সুন্দর বাঙালি জাতীয়তাবাদী আবহাওয়া দীর্ঘকাল থেকে ছিল। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সেখানকার কোনো বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের সম্পর্ক ছিল বলে তখন শুনিনি।
প্রগতিশীল বলে কথিত ও দাবিদার অনেকেই সেকালে ছদ্মবেশী মুসলিম জাতীয়তাবাদী ছিলেন। তারা সাম্প্রদায়িক ছিলেন তা-ও নয়, কিন্তু তাঁদের মুসলমান সত্তাকে প্রাধান্য দিতেন। সেকালের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, যেসব বাঙালি কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ ঢাকায় পাঞ্জাবি-পাজামা, প্যান্ট-শার্ট, স্যুট পরতেন, তাদের কেউ কেউ পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন আচকান ও চোস্ত পাজামা এবং মাথায় লিয়াকত টুপি বা আইয়ুব টুপি পরে। বিষয়টি হাস্যকর মনে হয়। পশ্চিম পাকিস্তান সফরে গিয়ে এমন অনেকে এ কাজ করেছেন, যারা আমাদের সবচেয়ে আধুনিক বলে পরিচিত ছিলেন।
রাষ্ট্র থেকে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা সুযোগ-সুবিধা নেবেন, তা দোষের নয়। অনেক সময় ভালো কাজের জন্য রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য প্রয়োজন। কিন্তু তা আত্মবিসর্জন দিয়ে নয়। পাকিস্তান আমলে বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা প্রচুর সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। তাঁরা সরকারি খরচে ব্যাপক বিদেশ সফর করেছেন; করাচি, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডিতে গিয়ে দামি হোটেলে থেকেছেন, আর্থিক সহায়তা নিয়েছেন, তা নিয়ে তারা কোনো অন্যায় করেননি। রাষ্ট্রের টাকা জনগণের টাকা, সরকারপ্রধানের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, সেকালে যাদের থেকে এই সুবিধা নিয়েছেন, ১৯৭২ থেকে তারা হয় তা অস্বীকার করেছেন অথবা গোপন করে গেছেন। এই অসাধুতা বা সৎ সাহসের অভাবেই তারা প্রশংসার যোগ্য নন।
রাষ্ট্রীয় আদর্শের সঙ্গে কোনো নাগরিক ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করতে পারেন না, অস্বীকার করাও সম্ভব নয়। একাত্তরের আগে বাঙালি কোনো লেখক বুদ্ধিজীবী তা করেছেন তার প্রমাণ নেই। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অত্যন্ত বিশ্বস্ত নাগরিক ছিলেন তাঁরা। অক্টোবর ১৯৬৮তে, মুক্তিযুদ্ধের সোয়া দুই বছর আগে, বাংলা একাডেমি সাহিত্য ও সংস্কৃতি সপ্তাহ পালনের আয়োজন করে। তাতে প্রধান বাঙালি কবি সাহিত্যিক অংশগ্রহণ করেন এবং প্রবন্ধ পাঠ করেন। সে সব লেখা দিয়ে সরদার ফজলুল করিমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় আমাদের সাহিত্য (১৯৬৯)। আমাদের সাহিত্য কোনো ভালো শিরোনাম নয়। বইটির নামকরণ হতে পারত পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা সাহিত্য আশির দশকের এক কবি সম্মেলনে আমি সরদার ফজলুল করিমকে জিজ্ঞাস করেছিলাম বইটির পুনর্মুদ্রণ না হওয়ার কারণ কী? তিনি ছিলেন সরল সজ্জন মানুষ। বললেন, ‘থাক, আর ওসব বই নিয়ে আলোচনা করা ভালো। অথচ বইটি কোনো আপত্তিকর বই নয়। মানসিক দুর্বলতা থেকে সেকালের অনেক ভালো বইটির কথাও বলতে সংকাঁচবোধ করতেন স্বাধীনতার পরে সেগুলোর লেখকেরাই। বাংলা একাডেমি আর একটি বই বের করেছিল, তার নাম। ‘পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম সাহিত্য (১৯৬৮)।