কেউ কেউ অনুরোধেও হয়তো-বা লিখে থাকবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেখার দায় লেখকেরই। মোহাম্মদ বরকতউল্লাহর মতো সৎ ও মননশীল ব্যক্তিত্ব এক নিবন্ধে লিখেছিলেন:
‘মৌলিক গণতন্ত্রের যে আদর্শ বর্তমান সরকার গ্রহণ করেছেন, তাতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত ও পূর্ণ হওয়ার সুযোগ রয়েছ যথেষ্ট।… ক্রমশ যোগ্যতর মানুষ সদস্য হয়ে হয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলে আসছে এবং গণতান্ত্রিক আদর্শকে পূর্ণভাবে রূপায়িত করতে এগোচ্ছে। ইহাই বর্তমান সরকারের আশা ও বিশ্বাস। ইহার চাবিকাঠিও জনগণেরই হাতে। তারা যদি ভোট দেবার সময় যোগ্য লোকদিগকে বাছাই করে ইউনিয়ন কাউন্সিলে পাঠায় তা হলে সমস্ত ঠিক হয়ে যাবে।’
[পাকিস্তানী খবর, ২৩ মার্চ ১৯৬৮]
যিনি ছিলেন আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিজগতের অভিভাবকতুল্য, সেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পল্লী তথা, দেশ উন্নয়নে এর [মৌলিক গণতন্ত্রের] উপকারিতা সম্বন্ধে’ লিখেছিলেন, এই গণতন্ত্রের এখনও শৈশব অবস্থা। কাজেই ভবিষ্যতেই আমরা তার পূর্ণ বিকাশ দেখতে আশা রাখি। যেমন ছেলে বড় হলে তবে তার ষোলআনা গুণ প্রকাশ পায়। … তারা নামাজ-রোজা প্রভৃতি ধর্মকার্যের জন্য উপদেশ দিয়ে, এবং যারা তা মানে না, তাদের জন্য সামাজিক শাসনের বিধান করে পাকিস্তানকে আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারেন। …এমন অনেক কাজ রয়েছে, যা মৌলিক। গণতন্ত্রের কল্যাণে আমরা সম্পাদন করতে পারি, যাতে করে একদিন এ দেশে government of the people, by the people, for the people অর্জন করা। সম্ভব হয়ে ওঠে।
[পাকিস্তানী খবর, ২৩ মার্চ ১৯৬৮]
মানুষ চাইছিল সর্বজনীন ভোটাধিকার ও সংসদীয় গণতন্ত্র, পরোক্ষ ইলেকটোরাল কলেজের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়। এসব প্রপাগান্ডায় মানুষ বিরক্ত হয়ে ওঠে এবং তিন মাস পরে গণরোষে আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হন।
০৮. আত্মপ্রতারণা
রাষ্ট্র একটি বাস্তবতা, কল্পলোকের কোনো বস্তু নয়। রাষ্ট্রের নীতি-আদর্শের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্য থাকতেই হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রটিও ছিল এক বাস্তবতা। তারও ছিল নিজস্ব নীতি-আদর্শ। শাসকেরা তার ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চাইতেন। নাগরিকেরা তার প্রতি অনুগত ছিলেন। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের সব নাগরিকই ছিল পাকিস্তানি, যদিও জাতিসত্তার দিক থেকে তাদের প্রায় ৯৮ শতাংশ ছিল বাঙালি, অবশিষ্টদের কেউ ছিল চাকমা, সাঁওতাল, গারো, হাজং, মণিপুরি, ত্রিপুরা প্রভৃতি। তবে ৯৯ শতাংশের বেশি মানুষ ছিল বাংলাভাষী।
বহু শতাব্দী বাঙালি– বাঙালি মুসলমান ছিল অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত। একপর্যায়ে তারা অর্থনৈতিকভাবে পড়ে পিছিয়ে এবং শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের দূরত্ব সৃষ্টি হয় প্রায় অনতিক্রম্য। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনে তারা শিকার হয় চরম বৈষম্যের। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে স্বশাসনের স্পৃহা জাগে। কৃষি অর্থনীতিতে বাঙালি মুসলমান কৃষকশ্রেণির বিপুল অবদান থাকা সত্ত্বেও তারা জমিদার-জোতদার-মহাজনদের শোষণের শিকার হয়। তাই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপিত হলে বাঙালি মুসলমান অপার আগ্রহ ও আশা নিয়ে তার সমর্থন করে। তাদের ভোটেই প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান। তাদের প্রত্যাশা ছিল পাকিস্তান হবে একটি শোষণমুক্ত ও ন্যায়বিচারভিত্তিক রাষ্ট্র।
লাখ লাখ হিন্দু পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে চলে যাওয়ার পরও পূর্ব পাকিস্তানের এক-চতুর্থাংশ মানুষ ছিলেন হিন্দুধর্মাবলম্বী। বাঙালি সংস্কৃতি ছিল হিন্দু মুসলমান প্রভৃতি সব ধর্মাবলম্বীর সমন্বিত সংস্কৃতি। সব ধর্মের উপাদান নিয়ে হাজার বছরে গড়ে উঠেছে সেই সংস্কৃতি। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় যত কথাই বলুন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লগ্নে গণপরিষদে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে ভাষণ দেন, তাতে পাকিস্তান একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে বলেই ঘোষণা দেন। রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না বলেই তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। স্বাধীনভাবে যে যার মতো ধর্ম পালন করবে, স্বাধীনভাবে কেউ যাবে মসজিদে, কেউ মন্দিরে, কেউ গির্জায়, কেউ প্যাগোডায় অথবা অন্য কোনো উপাসনালয়ে; তাতে রাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক নেই। রাষ্ট্র চলবে গণতান্ত্রিক বিধি অনুসারে। জিন্নাহ এ কথা বললেও সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগের নেতারা পাকিস্তানকে ‘এসলামি জমহুরিয়াহ’ বানাতে চাইলেন। সে জিনিসটি যে কী –তা দেশের মানুষ জানত না। শাসকশ্রেণির মধ্যে পূর্ব বাংলার বাঙালি নেতা অনেকে ছিলেন, তাঁরা বাংলাদেশকে ‘তৌহিদবাদী পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চাইলেন। এখানে যে এক-চতুর্থাংশ অমুসলমান, বিশেষ করে হিন্দু, বৌদ্ধ, আদিবাসী রয়েছে, তাদের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। নতুন রাষ্ট্রের সংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িকতা জায়গা করে নেয়।
পূর্ব বাংলার মুসলমান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নানা মতবাদে বিভক্ত ছিলেন। কেউ ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী, তাঁরা তাঁদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের জন্য মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যে হাতড়ে বেড়াতেন। কেউ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক আধুনিকতাবাদী, তাঁরা সংখ্যায় কম। আরও কম সংখ্যায় ছিলেন একদল, তারা সমাজবাদী ধ্যানধারণা। পোষণ করতেন। পল্লিপ্রধান দেশে বিশাল জনগোষ্ঠী অশিক্ষিত ও অজ্ঞতার অন্ধকারে পড়ে থাকায় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা তাদের সহজেই প্রভাবিত করতে পারতেন তাদের মতাদর্শে। ধর্মের নামে তাদেরকে শোষণ করা সহজ ছিল।