আজাদ ওয়াতান, স্বাধীন পাকিস্তান
মজলুমানের মঞ্জিল মহীয়ান।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের একনায়কত্বের সময় দেশে শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, অবকাঠামো প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অগ্রগতি হয়েছিল, কিন্তু জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করা হয়। বাম প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী নেতাদের অনেকেই কারারুদ্ধ হন। এমনকি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে সবচেয়ে। সোচ্চার আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে একটির পর একটি মামলা দিয়ে নাজেহাল করা হচ্ছিল। তারপর তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে প্রায় মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। দেশের লেখক-শিক্ষাবিদেরা এসবের। প্রতিবাদ না করে তাঁরা মৌলিক গণতন্ত্র ও নতুন বেতার নীতি বা প্রপাগান্ডা নীতির প্রশংসাই করতে থাকেন। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুবের পতনের মাত্র চার মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম, স্বাধীনতার পর পাকিস্তানকে যিনি বিরামহীন গালাগালি করতেন, এক প্রবন্ধে আইয়ুব সরকারকে পরামর্শ দিয়ে লেখেন :
‘বর্তমান বিশ্বে যে কোনো ক্ষেত্রে সাফল্যের একটি মস্ত বড় সোপান প্রচারকার্য। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক সর্বক্ষেত্রেই আজ প্রচারের মাধ্যমে কেউ বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে, আর কেউ বা এর অভাবে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে।…
‘প্রচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম বেতার। আজকাল এখান থেকে নিয়মিত মৌলিক গণতন্ত্রের উপদেশ দেয়া হয়ে থাকে।… পল্লী অঞ্চলের মৌলিক গণতন্ত্রীদের সহায়তায় আলোচনা সভার আয়োজন করা যেতে পারে। ঘন ঘন এ ধরনের সভা সমিতি ডাকলে নিশ্চয়ই গ্রামবাসীদের সাড়া পাওয়া যাবে।’
[নীলিমা ইব্রাহীম ‘সমবায় ও প্রচারকার্য’, দৈনিক পাকিস্তান, ৩ নভেম্বর ১৯৬৮]
আইয়ুব ক্ষমতা গ্রহণের এক দশক পূর্তি উপলক্ষে ১৯৬৭-র শেষ দিক থেকেই ব্যাপক প্রচারাভিযান শুরু করে সরকার। তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘উন্নয়নের দশ বছর’। সেটা যেকোনো সরকারই করতে পারে। আইয়ুব স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছিলেন বাঙালি বিদ্বৎসমাজের। ময়মনসিংহ মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ আজিজন নেসা (তমঘা-ই-কায়েদে আজম) লিখেছিলেন :
‘উন্নয়ন দশকের পটভূমিকায় দেখা যায়, জাতি তখন অনিশ্চয়তার পথে অগ্রসর হচ্ছিল। শঙ্কিত জনসাধারণ আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, কে দেখাবে আলো? কোন পথে চলব? একদিকে মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত, অন্যদিকে বিপর্যস্ত দেশ নানা সমস্যার সম্মুখীন। দেশ ও জাতির এই চরম দুঃসময়ে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে এগিয়ে এলেন নির্ভীক অকুতোভয়, একনিষ্ঠ, দুর্জয় মনোবলের অধিকারী এক নেতা ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান। বিহ্বল, মোহগ্রস্ত জাতিকে উদাত্ত আহ্বানে জাগিয়ে তুললেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান শাসনভার গ্রহণ করে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শাসনব্যবস্থার সনাতন কাঠামো ভেঙে আনলেন এক নববিপ্লব। শুধু শাসনব্যবস্থায় নয়, যা অসুন্দর, অসার্থক, অকল্যাণকর তা দৃঢ়চিত্তে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে দূর করে আহ্বান করলেন সুন্দর, সার্থক ও কল্যাণকে। তাই কল্যাণের মঙ্গলালোকে উদ্ভাসিত হলো চারদিক, সূচিত হলো শুভ পদধ্বনি।…
‘প্রেসিডেন্ট শাসনভার গ্রহণ করেছেন তা আজ এক দশক পূর্ণ হতে চলেছে। এই এক দশকের মধ্যে সারা দেশে এক নজিরবিহীন ও অভূতপূর্ব উন্নয়ন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। প্রেসিডেন্টের কর্তব্যপরায়ণতা প্রতিটি মানুষকে স্পর্শ করে সজীব করে তুলেছে। যে দিকে তাকানো যায় চোখে পড়ে কাজ আর কাজ। গোটা দেশটাই যেন হঠাৎ এক সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠেছে। কেউ আর আলস্যভরে আয়েশী জীবনযাপনের অবকাশ পাচ্ছে না। তামাম দেশটা এমনি কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে তা কেউ কি দশ বছর আগে ধারণা করতে শিখেছিল। একজন কিন্তু শিখেছিলেন তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে, দূরদৃষ্টি ও মননশীলতা দিয়ে। তিনি আর কেউ নন, আমাদের প্রিয় প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান।
[‘প্রদেশে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতি, দৈনিক পাকিস্তান, ৩ নভেম্বর, ১৯৬৮]
এই স্তৃতিমূলক লেখা প্রকাশের এক মাস পরেই আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু করেন মওলানা ভাসানী এবং দুই মাসের মধ্যে ঘটে গণঅভ্যুত্থান। আইয়ুব পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি যার হাতে ক্ষমতা দেন, তিনি মানবজাতির ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যাকারী।
আইয়ুব প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্র, যা সর্বজনীন ভোটাধিকারের পরিপন্থী, যার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ সংগ্রাম করছিল, তার প্রশংসা করে প্রচুর লেখালেখি হয়েছিল। কবি, কথাশিল্পী, প্রবন্ধকার ও শিক্ষাবিদ অনেকেই মৌলিক গণতন্ত্রের প্রশংসা করে লিখেছেন। সেকালের একজন খ্যাতিমান লেখক ও শিক্ষাবিদ জহুরুল হক লিখেছিলেন :
‘.. জাতির ইতিহাসের এক অত্যন্ত জরুরি মুহূর্তে ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের আবির্ভাব ঘটেছিল।
‘দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের স্তূপীকৃত আবর্জনা অপসারণ করে নুতনকে ও নির্মলকে নির্মাণ করে তোলার ব্রত তিনি গ্রহণ করেছিলেন।’
[জহুরুল হক, রাষ্ট্রপ্রথার বিবর্তন ও মৌলিক গণতন্ত্র, পাকিস্তানী খবর, পাকিস্তান দিবস সংখ্যা, ২৩ মার্চ ১৯৬৮, পৃ. ৩৯]