একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ও সেনাপতিদের নিয়ে ‘জল্লাদের দরবার’, ‘চরমপত্র’ প্রভৃতি হাস্যরসমূলক রচনা সম্প্রচারিত হতো, তেমনি পঁয়ষট্টিতে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে নানা রকম কৌতুক হতো ভারতকে নিয়ে। যেমন ফতেহ লোহানীর একটি কৌতুক রচনা, যার শিরোনাম ‘হিন্দুস্থানের পাঁচালী’। সেই পাঁচালীর নমুনা এ রকম :
প্রথমে বন্দিনু আমি সেই বিধাতারে,
অপার করুণা যার বিশ্ব চরাচরে।
এবার নমিনু আমি মোর বাপমায়
লভেছি জনম আমি যাদের কৃপায়।
এমন করিয়া স্মরণ যত গুরুজনে
জানাই সালাম যত সুধী জনগণে।
শোনো ভাই শোনো সবে শোনো দিয়া মন,
ভারত পাঁচালী তবে করহ শ্রবণ।
নয়ন মুদিয়া শোনো সুধা কর পান,
ভজেন লোহানী তবে ভারতের গান ॥
ধুয়া : আহা বেশ বেশ—
ভারত তাহার নাম কুহকিনী ভূমি
ভূগোলেতে জানি তাহা পড়িয়াছ তুমি।
অহিংসা বাণী যত বড় বড় বাত–
ছলনায় কত করে মহারথী কাত ॥
ধুয়া : আহা বেশ বেশ
… … …
তাকায়ে দেখ না দাদা প্রভুদের দিকে
পাঠায়ে তোমারে রণে তারা হাসি মুখে–
ঘরে বসে ছাড়ে বুলি গরম গরম–
প্রাণের বয়ান দিয়ে তুমি যে খতম।
ছেড়ে ছুঁড়ে ঘরে যাও, না হও বাতুল,
ঘরে বসে বাঁচা বাপু বামনের কূল।
যবনের হাতে মরে ফল কিরে ভাই,
মরে শুধু ভূত হবি আর গতি নাই।
সব শেষে খাঁটি কথা গোপনে জানাই–
হাতিয়ার ফেলে বল, তাই তাই তাই।
হাততালি দিয়ে বল, তাই তাই তাই ॥
ধুয়া : আহা বেশ বেশ…
[পুবালী, ভাদ্র, ১৯৭২)
পাঁচ
প্রচারমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সব কালের সব দেশের শাসকদের অভিন্ন নীতি। পাকিস্তান যুগে গণমাধ্যম বলতে ছিল সংবাদপত্র, রেডিও পাকিস্তান এবং একমাত্র টেলিভিশন মাধ্যম পাকিস্তান টেলিভিশন ঢাকা। ১৯৬৫-র সেপ্টেম্বর যুদ্ধের পরে পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টিতে পড়ে বেতারের ভূমিকা এবং কী করে তাকে পুরোপুরি সরকারি দলের নীতির বশবর্তী করা যায়। বিশেষ করে, ভারতবিরোধী প্রচারণাকে আরও জোরদার কীভাবে করা সম্ভব তার উপায় খুঁজে বের করা। যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার মাসখানেক পরেই কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন ঘোষণা করেন, সরকার বর্তমান বাস্তবতায় একটি নতুন বেতার নীতি প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, আকাশবাণী থেকেও পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণা ব্যাপকভাবে চলছিল। সেগুলো বাংলাদেশের শ্রোতারা শুনতেন। তাতে সত্য-মিথ্যা নানা বিষয় সম্প্রচারিত হতো। নোংরামি তাতে কম থাকত না।
১৯৬৫-র অক্টোবরে শাহাবুদ্দিন তার এক বক্তৃতায় বলেন, “রেডিও পাকিস্তানে ভারত হইতে প্রচারিত শত্রুতামূলক প্রচারণার পাল্টা কর্মসূচীর প্রচার অব্যাহত রাখা উচিত। সরকার অতি দ্রুত তার নয়া বেতার নীতি ঘোষণা করে। সেই বেতার নীতিতে অনেকগুলো নির্দেশনা ছিল। তার একটি এ রকম :
‘নাটকের অনুষ্ঠান আরও বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং ফসল তোলার গান, জিপসি গান, মৌসুমি গান, মুসলিম দেশসমূহের সংগীত, মহান মুসলিম গীতিকারদের জীবনী ও সংগীত ও অন্যান্য আকর্ষণীয় সংগীতানুষ্ঠান প্রচার করিতে হইবে। নৈরাশ্যবাদী গজল এবং গান পরিহার করিয়া প্রাণবন্ত ও উদ্দীপনাময় সংগীত অথবা নাটকীয় আবৃত্তি হিসাবে তেজোদ্দীপক কবিতা পেশ করিতে হইবে। নজরুল, ইকবাল ও অন্যান্য জাতীয় কবিদের সংগীত প্রচারের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হইবে।
এ ধরনের নির্দেশ দেওয়া ছিল শিল্পী ও কর্মকর্তাদের হাত-পা বেঁধে দেওয়ার শামিল। নৈরাশ্যবাদী গজল ও গানের সংজ্ঞা কী? এই সংজ্ঞা হিসেবে নজরুলের
গানগুলি মোর আহত পাখির সম
লুটাইয়া পড়ে তব পায়ে প্রিয়তম।
কিংবা
বিদায়-সন্ধ্যা আসিল ঐ
ঘনায় নয়নে অন্ধকার।
হে প্রিয়, আমার যাত্রাপথ
অশ্রু-পিছল করো না আর।
অথবা
আনো সাকি শিরাজী আলো আঁখি-পিয়ালায়।
অধীর করো মোরে নয়ন-মদিরায়।
প্রভৃতি রেডিও-টেলিভিশন থেকে সম্প্রচার করা যাবে না। শুধু প্রচারিত হবে ‘বীর-রসে উজ্জীবিত’ করার মতো গান। কিন্তু নজরুল ভারতীয় বাঙালি মুসলমান ছিলেন, পাকিস্তানের ‘জাতীয় কবি’ ছিলেন না।
এই জাতীয় আরও অদ্ভুত ফরমান-সংবলিত নীতিমালা তখন ঘোষিত হলো। এই নীতিমালা সমগ্র পাকিস্তানের জন্য প্রযোজ্য হলেও মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের শ্রোতারা। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বাংলা অনুষ্ঠানে পূর্ব বাংলার শ্রোতা প্রভাবিত হতে পারে, সেই শঙ্কা থেকেই এই ‘নয়া বেতার নীতি’। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, এই নীতিমালা ঘোষণার প্রতিবাদে অথবা এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে আমাদের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা একটি শব্দও বলেননি। তারা এটা মেনে নিলেন।
ফওজিয়া খান রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে ১৯৬৭-তে একটি গীতি-বিচিত্রা প্রচার করেন। তাতে ধারাবিবরণীতে তিনি বলেন, ‘আমাদের আজাদ ওয়াতান যেন আল্লারই দান। দেশের মাটির তরে এ দেশের প্রতিটি মানুষ উৎসর্গকৃত প্রাণ। জান দিয়ে হলেও দেশের মান ফিরিয়ে আনবার জন্যই যেন জন্মেছে এ দেশের লক্ষ কোটি নরনারী।’ [এলান]
শিক্ষিত বাঙালি অনেকেই সেদিন মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ‘আজাদ ওয়াতান’ বলতেই পছন্দ করতেন। যে শব্দ দুটি বাঙালি কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য মনে হতো। ওই ‘গীতি-বিচিত্রা’য় পরিবেশিত হয়েছিল যে গানটি, তা কবি হাবিবুর রহমানের রচনা : ‘আমাদের এই পাক আজাদ ওয়াতান/ দুনিয়ার জান্নাত আল্লার দান।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাত্র এক-দেড় বছর আগেও এসব গান রচিত ও পরিবেশিত হতো বেতারে। ফররুখ আহমদের একটি গানও ছিল খুবই প্রচলিত :