দেশপ্রেম ও কাশ্মীর নিয়ে কবিতা লিখেছেন প্রধান প্রায় সব কবিই। তাঁদের মধ্যে আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, তালিম হোসেন, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দিন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। দুই মাসে তালিম হোসেন লিখেছেন অনেক কবিতা। হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর এক দীর্ঘ কবিতায় বলেন :
আকাশের বিদ্যুতে দেখি স্বদেশের অন্য এক রূপ
অনিন্দ যুগ ধূপ
জনে জনে মনে মনে প্রদীপ্ত প্রগাঢ় উৎসুক্য
পুঞ্জিত সাহসে আজ ছড়ায় প্রবাল সখ্যে
বিপদে বিপন্ন নয় দেখে মুখ অজেয় অপার
বরাভয়ে শক্রজয়ী অকাতর স্বদেশ আমার।
[‘বিপদে বিপন্ন নও’]
পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিরোধ ও যুদ্ধ যেহেতু কাশ্মীর নিয়ে, তাই আমাদের কবিদের রচনার অন্যতম প্রধান উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায় কাশ্মীরও। ওই সময় প্রকাশিত ফররুখ আহমদের একটি সনেট এ রকম :
শহীদের খুন-রাঙা রুধিরাক্ত মাটির জান্নাত,
বর্বর পশুর বন্য অত্যাচার বিধ্বস্ত কাশ্মীর
আজাদীর স্বপ্ন দেখে দীর্ঘদিন, দীর্ঘতর রাত;
আবদ্ধ জিঞ্জির বেয়ে ঝরে তার শহীদি রুধির।
জাফরানের স্বপ্ন তার ধূলিস্নান রক্তাক্ত সগ্রামে
শান্তির পসরা তার চূর্ণ হলো সুতীব্র সংঘাতে,
সেই জেহাদের সঙ্গে মুমিনের মন ওঠে-নামে;
উদগ্র ব্যাকুল চিত্ত তার সঙ্গে শোণিত ঝরাতে।
তার আজাদীর দাম দিতে আজ সগ্রাম উৎসুক
প্রতি মুমিনের মন –শহীদ মৃত্যুর বিনিময়ে,
শৃংখলিত জীবনের কারাবন্ধে একাগ্র উন্মুখ
নিপীড়িত জনমন মুক্তি চায় ব্যাকুল হৃদয়ে।
শহীদের খুন-রাঙা বন্দিনী যে জান্নাত মাটির
স্বপ্নে দেখে আজাদীর;-অত্যাচার বিধ্বস্ত কাশ্মীর।
[কাশ্মীর]
যুদ্ধের সময় শামসুর রাহমান একটি ছোট কাব্যনাটক লিখেছিলেন, সেটিরও বিষয়বস্তু কাশ্মীরে যুদ্ধ। পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকার হাডিয়ারা নামক একটি গ্রামে এক মসজিদের ইমাম সাহেবের কথা পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হয়। ‘পাকিস্তানের ওপর হিন্দুস্থানের আচমকা হামলার দুর্যোগ-মুহূর্তে হাডিয়ারা গ্রামের মসজিদের ইমাম দুশমনদের সামনে মরদে-মোমিনের মতোই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং হানাদার বর্বর দুশমনদের হাতে অবশেষে শাহাদত্বরণ করেন। সেই পুণ্যকাহিনী বিবৃত হয়েছে এই কাব্য-নাট্যে। শামসুর রাহমানের কোনো কাব্যগ্রন্থে কাব্য নাটকটি আগে প্রকাশিত হয়নি। পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করে আমি তাঁকে কাব্য নাটকটি দিয়েছিলাম। ‘তিনটি গোলাপ’ শীর্ষক কাব্য নাটকটির আরম্ভ এ রকম:
ইমাম :
কী নিবিড় শান্তি চতুর্দিকে রক্ত গোলাপের মতো
ফুটে ওঠে ভোর আর বাতাসে ছড়ায় সুরভি অনেক পাখিদের গানে।
হৃদয় ঝংকৃত হয়। রাত্রি ছিঁড়ে সকালকে ডেকে আনে রোজ
মোরগের ডাক– হে রাম্বুল আলামীন আমাকে দিয়েছো ঠাঁই তোমার এ ঘরে।
প্রাণের চেয়েও প্রিয় এ ধূলিকণা, বুঝি তাই
এই মাটি মেখেছি তো চোখে বুকে, করেছি চুম্বন
পরম পবিত্র জেনে, ধুয়েছি সিঁড়ির ধাপ, রৌদ্রে বৃষ্টি মাখা
এই যে মিনার সেও ছুঁয়েছে হৃদয়
দূর নীল আসমানে ওড়ে কবুতর এক ঝাঁক–
মহানন্দে, আন্দোলিত পত্র গুচ্ছে, ফলে ফুলে
তোমারই মহিমা মূর্ত। বহুদিন পর
কাল রাতে স্বপ্নে আমি দেখেছি তো তিনটি গোলাপ, দেখেছি হৃদয়ে
তিনটি গোলাপ ফুটে উঠেছিলো স্বর্গীয় বিভায়।
কে ওখানে দাঁড়িয়ে একাকী?
গ্রামবাসী :
আমি এ গাঁয়ের লোক, মাঝে মাঝে আসি
এখানে নোয়াতে মাথা খোদার এ ঘরে
ইমাম :
জামাত হয়েছে শেষ, সূর্যের সোনালি আলো হয়েছে প্রখর;
অবশ্য খোদার ঘর খোলা সর্বদাই, দ্বিধাহীন আসুন করুন এবাদত।
গ্রামবাসী :
ধন্যবাদ, তবে আমি আসিনি এখন
বন্দেগির পুণ্যলোকে মগ্ন হতে, আজ শুধু এ মুহূর্তে এসেছি জানাতে
কিছু কথা, আপনি কি শুনেছেন কিছু?
ইমাম :
কেন কী হয়েছে? আমি তো জানি না কিছু–
পড়ে থাকি এখানেই এক কোণে একা,
কারো সাতে পাঁচে মন যায় না সহজে।
গ্রামবাসী :
শত্রুরা দিয়েছে হানা আমাদের গ্রামে, আমাদের প্রিয় হুদায়রা
হয়েছে আক্রান্ত আজ, শত্রুর ভীষণ ক্রুর থাবা পড়েছে মাটির বুকে, শকুন
ফেলেছে ছায়া শান্তি ছাওয়া ঘরে।
গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে লোক, হয়েছে হুকুম–
চলুন না আপনিও যাবেন এখন শত্রুরা পড়বে এসে কিছুক্ষণ পরে।
ইমাম :
শত্রুরা দিয়েছে হানা আমাদের গ্রামে?
লোকজন যাচ্ছে চলে? যাক, সব যাক,
আমি তো যাবো না ভাই। এই মসজিদ ছেড়ে আজ
বলুন কোথায় যাবো? জীবনের অনেক বছর কাটিয়েছি
এর ধূলিকণা মেখে সর্বাঙ্গে আমার।
এখন কোথায় যাবো? না, না, কিছুতেই পারবো না যেতে।
সোরিশ কাশ্মীরির একটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী, তার শিরোনাম ‘সালাম পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গনে বাঙালি সৈনিকদের বীরত্বের প্রশংসা করা হয়েছিল কবিতাটিতে। কবিতাটির শুরু এ রকম :
দেখেছি তাদের আমি কোষমুক্ত তরবারি যেন,
তাদেরে প্রণতি আজ
হে বাংলার আগ্নেয় যৌবন,
তোমাদের সালাম, সালাম ॥
তাদের অমিত তেজ, বীর্য চির তারুণ্য আভায়
ঝলমল, যেন চিরন্তন
তাদের অশনি ভরা কণ্ঠে শুধু ওই বজ্র ভেরী
প্রতিশোধ, চাই প্রতিশোধ।
তাদেরে প্রণতি আজ
হে বাংলার আগ্নেয় যৌবন
তোমাদের সালাম সালাম।
আঘাতে আঘাতে পর্যুদস্ত শত্রুসেনা
হানাদার বৈরী ভারতীয়–
মরণ বরণে, উল্লসিত কণ্ঠে তার বজ্র ভেদী ধ্বনি
আল্লাহু আকবর।
লাহোর রক্ষায় তারা পরাক্রান্ত বাহু
হয়েছে জাতির কাছে চির-বরণীয়।
হে বাংলার আগ্নেয় সন্তান
তোমাদের সালাম, সালাম।