[কবীর চৌধুরী, ‘যুদ্ধ ও আমাদের নবচেতনা’ এলান]
যুদ্ধ হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে, পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হয়নি। সেটাও খুবই তাৎপর্যের ব্যাপার। এই প্রদেশের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। তারা পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলমান সৈনিকদের বীরত্বগাথাকেই উপজীব্য করেন তাদের লেখায়। যুদ্ধের সঙ্গে ইসলামেরও কোননা সম্পর্ক ছিল না, যুদ্ধ হয়েছিল এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক রাষ্ট্রের –এক ধর্মের সঙ্গে আরেক ধর্মের নয়।
সেদিন বাঙালি মুসলমান কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, শিক্ষাবিদ প্রমুখের লেখায় যে আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছিল, তা কি মিথ্যা ছিল? তা কি কৃত্রিম ছিল? সে প্রশ্নের জবাব শুধু সেই লেখকেরাই দিতে পারবেন।
চার
যেকোনো যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে প্রপাগান্ডা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। সে কাজটি সরকারের প্রচার বিভাগই করে থাকে। কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদেরও ভূমিকা থাকে, কারণ জাতীয় নিরাপত্তা সবার ওপরে। বহু ব্যাপারে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতে পারে; কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে দ্বিমত থাকে না কোনো নাগরিকেরই। ৬৫-র পাকিস্তান-ভারত সেপ্টেম্বর যুদ্ধে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণ ছিল অনেকটাই রণাঙ্গনের সৈনিকদের মতো। যুদ্ধ-পরবর্তীকালের একটি লেখা থেকে বোঝা যায়, তখন আমাদের লেখকেরা কী ভূমিকা পালন করেছিলেন :
‘মুখে গণতন্ত্রের মুখোশ, কণ্ঠে শান্তির সুললিত বুলি, গায়ে পরম বৈষ্ণবের নামাবলী, সাম্রাজ্যবাদী ভারত পূর্বাহ্নে যুদ্ধ ঘোষণা না করেই সন্তর্পণে আক্রমণ করল পাকিস্তানের পাকভূমি। আন্তর্জাতিক চুক্তিকে উপহাস করে লাহোর জিমখানায় চা পান করবার মোহে অন্ধ হয়ে ভারতের ট্যাংকবাহিনী আক্রমণ করল পশ্চিম। পাকিস্তানের রাজধানী লাহোর। কিন্তু ভারতের এই সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধি ও হীন আক্রমণকে ব্যর্থ করে দিয়ে পবিত্র মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে বজ্রের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নিয়ে রুখে দাঁড়াল পাকিস্তানের বীর সেনানী। জলে-স্থলে আকাশে বীর সেনানীরা শত্রুর হামলাকে পর্যুদস্ত করল। ইতিহাসে তাদের বীরত্বের গাথা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হল।
‘ভারতের এই তস্কর সুলভ আক্রমণের প্রতিবাদ জানাতে সেদিন শুধু বীর সৈনিকদের কামানই গর্জে উঠেছিল না, প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল খাইবার থেকে টেকনাফের প্রতিটি জনপদ। সবাই এক সঙ্গে এক কণ্ঠে গর্জে উঠল, শক্রকে ধ্বংস করতেই হবে। রণাঙ্গনে যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের বীর সৈনিকরা, তেমনি দেশপ্রেমিক লেখক ও কবিদের লেখনী হয়ে উঠল ক্ষুরধার। কামানের মতো তাদের লেখনীও আগুন ছড়াল। আর সেইসব রচনা শিল্পীর অন্তরের উত্তাপে প্রাণস্পর্শী সুরে বেজে উঠল কণ্ঠে কণ্ঠে।
[মোবারক হোসেন খান, ‘রক্ত-লেখা’]
দেশবাসীকে স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত করা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকা দোষের কিছু নয়, বরং খুব বড় গুণ। কিন্তু আমাদের কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো কথা বলতেন না। যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত ছিল। কবি-লেখক-সাংবাদিকেরা শুধু সেনাবাহিনীর বীরত্বগাথাকেই তুলে ধরেছেন। লেখক-শিল্পীদের মধ্যে আত্মতৃপ্তিও ছিল খুব বেশি। ওই প্রবন্ধে সে কথাই বলা হয়েছে :
‘আমাদের সেনাবাহিনীর বীরত্বের সঙ্গে আমাদের দেশের কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও শিল্পীরা যে অভূতপূর্ব দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ইতিহাসের এক উজ্জ্বল ও গৌরবময় অধ্যায় রচনা করলেন তা ভবিষ্যৎ দেশবাসীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।’
বাঙালি জাতির নিয়তির নির্মম পরিহাস, মাত্র পাঁচ বছর পর ওই পাকিস্তানি সেনারাই আঘাত হানে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি লেখক, সংগীতশিল্পী, কবি ও বুদ্ধিজীবীর ওপর। অসংখ্য কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দালাল আলবদর, আলশামস ও রাজাকারদের হাতে পাশবিক নির্যাতনে শহীদ হন একাত্তরে। ভারতীয় বাহিনী তখন বাঙালির মিত্রবাহিনী।
পঁয়ষট্টিতে সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া তমদ্দুন মজলিশের তৎপরতা ছিল সবচেয়ে বেশি। তারা কয়েক মাস ঘন ঘন সভা-সমাবেশ করেছে। কখনো আলোচনা সভা করেছে বাংলা একাডেমিতে। সেখানে খ্যাতিমান বৃদ্ধ-বুদ্ধিজীবীরাই অংশ নিতেন। যুদ্ধের পরেও তারা ‘সমর সাহিত্য’ রচনার ওপর জোর দিয়েছেন। বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এক ‘জঙ্গি সাহিত্য সভা’য় সভাপতিত্ব করেন একাডেমির পরিচালক সৈয়দ আলী আহসান। বক্তারা পূর্ব বাংলার ‘সাহিত্যের ধারা বীররসে উজ্জীবিত’ করে প্রবাহিত করার উপদেশও দেন।
ওই সময় কবি-লেখকদের প্রায় সবাই কম-বেশি দেশপ্রেমমূলক লেখা লিখেছেন। পরিমাণে যারা সবচেয়ে বেশি লিখেছেন, তাঁদের একজন হাসান হাফিজুর রহমান, পাকিস্তানি ‘সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রশ্নে তিনি নানা পরামর্শ দেন। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পরে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের প্রশ্নে’ নতুন করে ভাবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। আমাদের সাহিত্যে যাতে পাকিস্তানি জাতির বহুমুখী জীবনচেতনার প্রকাশ ঘটে, সে কথাও বলেন। যুদ্ধের পরেও তাদের আবেগ থেকে যায়, সে জন্য তাঁদের রচনার ভাষাও ঝরঝরে নয়, আবেগে অস্পষ্ট। হাসান হাফিজুর রহমানকে বলতে দেখি ‘সমগ্র জাতির ভেতরে এক অবিচ্ছিন্ন ঐক্য-শিহরণ সঞ্চার করা লেখকদের দায়িত্ব। যুদ্ধের পরে যেসব লেখক-সাংবাদিককে পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গন ও আজাদ কাশ্মীর ঘুরিয়ে আনা হয় হাসান ছিলেন তাঁদের একজন। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন তিনি তার সীমান্ত শিবির বইতে।