চল্লিশের শেষে এবং পঞ্চাশের শুরুতে যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পান, তাঁদের একটি অংশ পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে, সমাজে ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁরা অনেকে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ধারণ করেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা। তারা বামপন্থী ধারার সঙ্গে যুক্ত হন এবং আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস স্থাপন করেন। অর্থাৎ পঞ্চাশ দশকের শুরুতেই বাঙালি মুসলমান তরুণ-তরুণীদের অনেকের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। সবার অজান্তেই যেন ঢাকায় এক নীরব বিপ্লব ঘটে যায়। যাদের বাপ-চাচারা স্লোগান দিতেন ‘নারায়ে তকবির’; তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে আইপিটিএর গণসংগীত:
‘নওজোয়ান নওজোয়ান।
বিশ্বে এলো নওজোয়ান।’
অথবা নজরুলের–
‘ওড়াও ওড়াও লাল নিশান।
দুলাও মোদের রক্ত-পতাকা।
ভরিয়া বাতাস জুড়ি বিমান।
ওড়াও ওড়াও লাল নিশান।’
কিংবা নজরুলেরই
‘জাগো অনশন-বন্দী, ওঠরে যত
জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত।’
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই আন্তর্জাতিকতা ও বামপন্থার এই যে সূচনা, তার অর্থ এই ছিল না যে তারা পাকিস্তানকে অস্বীকার করছিল। বরং পাকিস্তানই করে দেয় তাদেরকে এক নতুন সুযোগ– খুলে দেয় আত্মবিকাশের দরজা। তবে তারা খুব সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ করেন, যতটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সময় প্রত্যাশা করেছিলেন তা থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছেন। সে জন্যই তারা উপলব্ধি করেন, আর্থসামাজিক মুক্তির জন্য তাঁদের আরও আন্দোলন ও লড়াই-সংগ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। সেই উপলব্ধি থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রামের প্রস্তুতি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর একটি গোত্র নিজেদের অতি অসাম্প্রদায়িক, সম্পূর্ণ ষোলো আনা সেকুলার ও প্রবল প্রগতিশীল প্রমাণ করতে গিয়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে অবিরাম গালাগাল করতে থাকে। (যে তত্ত্ব জিন্নাহ নিজেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক দিন আগে ১৩ আগস্ট ১৯৪৭ বর্জন করেন এবং গণপরিষদে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন, পাকিস্তান হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ইসলামি রাষ্ট্র নয়, যেখানে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ধর্মের কোনো সম্পর্কই থাকবে না।) তারা একাত্তরে ইয়াহিয়া-টিক্কা-ফরমানের গণহত্যা ও বর্বরতার সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে এক করে ফেলেন। ১৯৯৬-র পর থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা যে একটি জঘন্য ব্যাপার ছিল, তা অব্যাহত বলা অনেকের মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। তবে এখন এমন অনেকে এসব বলছেন পাকিস্তান সরকার থেকে যারা সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিয়েছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে যাদের কোনো ভূমিকাই নেই। পাকিস্তান না হলে তাঁরা কলকাতায় কিংবা কোনো মফস্বল শহরে মর্যাদাহীন জীবন যাপন করতেন।
অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী একটি পরাবৃত্তিকালে বা ট্রানজিশনের সময় কিছু বিশেষ সুবিধা দাবি করে। ১৯৪৭-এর আগে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের– বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের মুসলমানদের –অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলার মুসলমানদের চেয়ে ভালো ছিল। উর্দুর মাধ্যমে তারা ধারণ করতেন সর্বভারতীয় সংস্কৃতি। বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত নিজস্ব সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক। ঐতিহ্যের অধিকারী, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, শিক্ষায় পিছিয়ে। তাদের ভূখণ্ডে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হতে চেয়েছিল। তাদের পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণ সেটাই। ওই ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে যে দোষ ছিল না, তা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বাংলার মানুষ দ্বিতীয়বার প্রমাণ করেছে।
বাঙালির মহত্তম সৃষ্টিশীল প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ও সমস্যা নিয়ে ভেবেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বহু আগে, ১৯১১ সালে, তিনি লিখেছিলেন :
‘হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে যে একটি সত্য পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই। প্রয়োজন সাধনের আগ্রহবশত সেই পার্থক্য যদি আমরা না মানি তবে সেও আমাদের প্রয়োজন মানিবে না।
‘হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সকল দিক দিয়া একটা সত্যকার ঐক্য জন্মে নাই বলিয়াই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে এক করিয়া তুলিবার চেষ্টায় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সূত্রপাত হইল। এই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমরা মুসলমানকে যখন আহ্বান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজ উদ্ধারের সহায়ক বলিয়া ডাকিয়াছি, আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে কাজের জন্য আর দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পিছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না। তাহাকে যথার্থ আমাদের সঙ্গী বলিয়া মনে করি নাই, আনুষঙ্গিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছি। যেখানে দুই পক্ষের মধ্যে অসামঞ্জস্য আছে সেখানে যদি তাহারা শরিক হয়, তবে কেবল ততদিন পর্যন্ত তাহাদের বন্ধন থাকে যতদিন বাহিরে কোনো বাধা অতিক্রমের জন্য তাহাদের একত্র থাকা আবশ্যক হয়,–সে আবশ্যকটা অতীত হইলেই ভাগবাটোয়ারার বেলায় উভয় পক্ষেই ফাঁকি চলিতে থাকে।