[কবীর চৌধুরী, ‘যুদ্ধ ও আমাদের নবচেতনা’, এলান, অক্টোবর ১৯৬৫]
সেপ্টেম্বর যুদ্ধ নিয়ে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের লেখাগুলো, প্রশংসামূলক বিশ্লেষণধর্মী নয়। যুদ্ধে শুধু পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর শৌর্য-বীর্যের প্রকাশ ঘটেছে এবং ভারতীয় বাহিনী বিপর্যস্ত হয়েছে– এই বক্তব্যে বস্তুনিষ্ঠ নেই। কবীর চৌধুরী তার ওই প্রবন্ধে বলেন :
‘সব কিছুর আগে যে কথা ধরা পড়েছে তা হলো এই যে, এই পাক-ভারতের সেপ্টেম্বর যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমরা পাকিস্তানের সত্যিকার শক্তি ও সম্ভাবনার স্বরূপ আবিষ্কারে সমর্থ হয়েছি। জাতির জীবনে সংকট মুহূর্তও যে মাঝে মাঝে অভাবিত শুভ ও কল্যাণের বীজ বহন করে আনতে পারে তার প্রমাণ রয়েছে বিগত সংগ্রামের। ফলাফলের মধ্যে। পাকিস্তানের সামরিক শক্তি সম্পর্কে আমরা বরাবরই শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাবান ছিলাম; এবং এবারকার যুদ্ধ যে আমাদের সেই শ্রদ্ধা ও আশাকে পূর্ণ করেছে তাই নয়, তাকে বহু গুণ ছাড়িয়ে গেছে। সংখ্যায় তার চাইতে দশগুণ বেশি সৈন্যের মোকাবিলা করেছে পাকিস্তান, তবু শত্রু সৈন্যকে তারা বারবার ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে, পিছনে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে, চরম বিপর্যয় বরণ করতে বাধ্য করেছে। গত মহাযুদ্ধে মেসোপটেমিয়ার মরু প্রান্তরে আল-আমীনের রোমেল ও মন্টগোমারীর বাহিনীর মধ্যে যে বিরাট ও প্রচণ্ড ট্যাঙ্ক যুদ্ধ সংঘটিত হয় তার চাইতেও ভয়ঙ্কর ট্যাঙ্ক সংঘর্ষ হয়েছে এবার শিয়ালকোটের রণপ্রাঙ্গণে। হিন্দুস্তান তার সাঁজোয়াগাড়ীর সংখ্যাধিক্যের অহমিকায়– প্রচুর সৈন্য-সমাবেশ করে এই সেক্টরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল, কিন্তু আমাদের সিংহবিক্রম জোয়ানদের সামনে তাদের সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। এই যুদ্ধেই তাদের ট্যাঙ্ক বাহিনীর অপূরণীয় ক্ষতি ঘটে, হিন্দুস্তানের সামরিক শক্তির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধে যে অপূর্ব বীরত্ব, মৃত্যুঞ্জয়ী সাহস ও আশ্চর্য রণনৈপুণ্য প্রদর্শন করেছে তা আমাদের ইতিহাসে চিরদিন সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।
আমরা তখন তরুণ লেখক। লক্ষণীয় যে, ষাটের তরুণ লেখকেরা পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ নিয়ে মোটেই মাতামাতি করেননি। প্রবীণ সব লেখকই ওই যুদ্ধকে পাকিস্তানের সংহতির জন্য আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করেন। নবীন লেখকদের অনেকেই পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যকেই বড় করে দেখতেন। রাষ্ট্রে বৈষম্য টিকিয়ে রেখে সংহতি সম্ভব নয়। ওই লেখায় কবীর চৌধুরী আরও বলেছিলেন :
‘সংখ্যাগুরু হিন্দুস্তানের সামরিক বিপর্যয় ও সংখ্যালঘু পাকিস্তানের শক্তি মত্তার অবিসংবাদিত পরিচয় শুধু এশিয়ার নয়, আজ সমগ্র বিশ্বের কাছে একটি চরম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর জন্য সব প্রশংসা পরম করুণাময় আল্লাহর, যার অপার অনুগ্রহেই আমাদের সত্য ও ন্যায়ের যুদ্ধ সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে।
‘এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি। সে হচ্ছে সংকট মুহূর্তে পাকিস্তানের আশ্চর্য জাতীয় চেতনার উন্মেষ– এক অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য, ইমান ও শৃঙ্খলার অভিব্যক্তি। সাধারণ ও স্বাভাবিক অবস্থায় দেশের ভেতর নানা প্রশ্নে আমরা বিভিন্ন মতবাদের প্রকাশ দেখেছি; তর্ক, মতানৈক্য, আলোচনা ও সমালোচনা আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের স্বাভাবিক অঙ্গ হিসেবেই আমরা লক্ষ্য করেছি। একটি স্বাধীন, জীবন্ত এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেইটিই ছিল সঙ্গত ও স্বাভাবিক। মূল লক্ষ্য ও আদর্শের প্রতি অবিচলিত নিষ্ঠার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই সেইসব মতানৈক্য ও বিভেদ প্রশ্রয় পেতো। অন্তত তাই ছিল আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু সে বিশ্বাস যে কতখানি সত্য ও যথার্থ এবারকার অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে জাতি তার অবিস্মরণীয় প্রমাণ দিল। সাম্রাজ্যবাদী হিন্দুস্তানের নির্লজ্জ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সারা পাকিস্তান, পেশোয়ার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত, এক বজ্র কঠিন ঐক্য বন্ধনে একত্রিত ও সংঘবদ্ধ হল। নিজেদের আভ্যন্তরীণ প্রশ্নের সকল রকম তুচ্ছ বিবাদ-বিসম্বাদ বিস্মৃত হয়ে সারা জাতি হিন্দুস্তানের বর্বর আক্রমণ প্রতিহত করবার দৃপ্ত শপথ নিয়ে জীবনপণ করে রুখে দাঁড়াল। খাইবার থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত সর্বত্র দেখা গেল এক আশ্চর্য মৈত্রীর বন্ধন, সে বন্ধনের পশ্চাত্যে মূল সূত্রটি অত্যন্ত সহজ অথচ ইস্পাতের মতো কঠিন। তা হল, আমরা পাকিস্তানি, পাকিস্তান আমাদের প্রাণাপেক্ষা প্রিয় মাতৃভূমি, এই দেশের সেবায় আমরা সর্বস্ব দান করতে শুধু প্রস্তুত নই, উন্মুখ।…
‘এক আশ্চর্য সংহতি ও ঐক্য দেশের সর্বস্তরের মানুষকে আজ উদ্দীপিত করেছে। শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শিল্পপতি, শ্রমিক, চাষী, ব্যবসায়ী পর্যন্ত সবাই নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা বিস্মৃত হয়ে দেশের ডাকে গভীর ব্যগ্রতা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন; কোনো রকম সরকারি নির্দেশের জন্য তাঁরা অপেক্ষা করেননি; নিজেরাই নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ করে সৃষ্টিশীল গঠনমূলক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। যে নবচেতনার স্রোত সারা দেশে প্রবাহিত হল, তারই ফসল হিসেবে সৃষ্টি হলো কত নতুন গান, কবিতা, নাটক ও অন্যান্য রচনা।