পাকিস্তানের সেনাপতিদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, তারা গ্রিক আলেকজান্ডার এবং মঙ্গলীয় দিগ্বিজয়ী চেঙ্গিস খাঁর চেয়ে বড় বীর। তাদের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এমন শক্তি কোনো দেশের নেই। যুদ্ধ ছিল তাদের কাছে প্রিয় জিনিস। ভারতের সঙ্গে ১৯৪৭-এ জন্মলগ্নেই একবার যুদ্ধ হয়ে গেছে। নতুন রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক উন্নতি ও জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের বিষয়টিই প্রাধান্য পাওয়ার কথা, যুদ্ধবিগ্রহ করে শক্তি ক্ষয় উন্নয়নের পথে বড় বাধা। কয়েক মাস ধরেই দুই দেশের প্রস্তুতি বা । পাঁয়তারা চলছিল। শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান না করে বাধিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধ। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫। সত্যি সত্যি কে কাকে প্রথম আক্রমণ করে, তা কোনো দেশের ভাষ্য থেকেই জানা যাবে না, বিধাতা বলতে পারেন।
কোনো দেশ আক্রান্ত হলে অথবা নিজেই যুদ্ধ বাধিয়ে দিলে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য সরকারকে সহযোগিতা বা সমর্থন দেওয়া। পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত না হলেও পূর্ব বাংলার মানুষও বিপন্ন বোধ করে এবং সরকারের পাশে থাকে। বাঙালি লেখক-সাংবাদিক-শিক্ষাবিদ সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা দেবেন। সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তাঁদের ভাষা এবং সাম্প্রদায়িক শাসকশ্রেণির নেতাদের ভাষা একই রকম হবে, সেটা স্বাভাবিক নয়। যুদ্ধ নিয়ে সব দেশেই কবি-সাহিত্যিকেরা লেখালেখি করেন। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে মহৎ সাহিত্য রচিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়, ১৯৬২-তে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরা প্রচুর লিখেছেন। কলকাতার সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় একটি লেখার শিরোনাম ছিল “ড্রাগনের দাঁতে বিষ’, বহুদিন আমরা সেটা পড়েছি।
যুদ্ধ হয়েছিল ১৭ দিন। দৈনিক পাকিস্তান-এর সহকারী সম্পাদক কবি হাসান হাফিজুর রহমান ‘এ মুহূর্তে লেখকবর্গ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছিলেন :
‘পবিত্র মাতৃভূমি রক্ষার সংগ্রামে শরীক হওয়া মাত্রই আমাদের লেখকবৃন্দও এক মহান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হয়ে উঠলেন। জাতির বীর্যবত্তা এবং অমিত তেজ আমাদের চেতনায় আন্দাজ মাত্র ছিল, সে ত এখন বাস্তবে সত্য হয়ে উঠল, জ্বলন্ত নিদর্শন রূপে দীপ্ত দৃষ্ট হয়ে উঠল। আর সেই সঙ্গে প্রবহমান সুপ্রাচীন শৌর্যের অন্তর শক্তি যা আমরা ধারণ করছি বলে একটা সুপ্ত আশ্বাস মাত্র ছিল, তা বর্তমানের প্রগাঢ় উদ্দীপনায় প্রবল বিশ্বাসে পরিণত হল, পরীক্ষিত হতে উত্তীর্ণ হয়ে উঠল আমাদের মনে।…
‘আমাদের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনে তাই এই উদ্দীপ্ত বর্তমান মহত্তম ঘটনা। এতে আমরা আমাদের অন্তর্জগৎ দেখেছি, আমাদের সম্প্রসারণের পূর্ণতার ব্যাপ্তিও দেখেছি। প্রথমত আমরা জানতে পেলাম আমাদের প্রতিরোধ শক্তি অজেয়। দ্বিতীয়ত ন্যায় ও নীতির জন্য আমাদের ত্যাগের মজ্জাগত শক্তি রয়েছে। নির্যাতিতের সপক্ষে দাঁড়াবার সাহস আমাদেরকে যে কোন বিপদের সম্মুখেও অটল থাকার প্রেরণায় অনিঃশেষ, অকুতোভয়। তৃতীয়ত, মাতৃভূমির মর্যাদা ও মানুষ হিসেবে আমাদের আত্মসম্মানবোধ আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয়।… এই সবই একটি বীর জাতির গুণাবলী। আমাদের এই মহৎ জাতীয় পরিচয় আজ দ্ব্যর্থহীন স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করল।
‘কোন মহৎ ঘটনা ছাড়া একটি জাতি নিজেকে পুরোপুরি চিনতে পারে না। নতুনভাবে জানতে পারে না, সম্পূর্ণ আত্মোপলব্ধি তার ঘটে না। বর্তমান বিপদকে এক মহৎ ঘটনাই বলব। কারণ, এর ফলে আমরা রাষ্ট্রিক দিক থেকে যেমন নিঃসন্দেহে এক বহুমুখী বিজয়ের সম্মুখীন হয়েছি, তেমনি এ আমাদের আত্মিক জগতের বহুমুখী সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। আমাদের লেখকবর্গ এই আত্মিক সম্ভাবনার রূপায়ণের প্রবর্তনার এবং প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।’
যুদ্ধের মধ্যে এবং যুদ্ধের পরে বহুদিন বাংলাদেশের প্রধান কবি-সাহিত্যিকেরা লেখালেখির মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেমের আবেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেননি মাত্র পাঁচ বছর পরে পাকিস্তান সরকার ও তাদের সেনাবাহিনী হবে বাঙালির জঘন্য দুশমন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমস্ত বীরত্বের প্রকাশ ঘটবে নিরপরাধ বাঙালির রক্তলেহনে। অক্টোবর ১৯৬৫-তে বাংলা একাডেমির পরিচালক (তখনো মহাপরিচালক পদটি সৃষ্টি হয়নি) কবীর চৌধুরী লিখেছিলেন :
‘শান্তিকামী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যখন অতর্কিত সশস্ত্র আক্রমণ করে সাম্রাজ্যবাদী হিন্দুস্তান পাক-ভারতের সেপ্টেম্বর যুদ্ধ তার ওপর চাপিয়ে দিল তখন পাকিস্তান অপূর্ব শৌর্য ও বীরত্বের সঙ্গে সে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছে। সকল রণাঙ্গনে শত্ৰু পিছু হটে গেছে এবং প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি বরণ করেছে। অবশ্য পাকিস্তানের দিক থেকে সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। সব সমস্যার মূল সেখানে, অর্থাৎ জম্মু ও কাশ্মীরী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার যতদিন পর্যন্ত বাস্তব ব্যবস্থায় কার্যকরী না হয় ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তান এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রত্যাশা করতে পারে না। তার অতীত ইতিহাস দিয়ে বিচার করলে এ সিদ্ধান্ত অবধারিত হয়ে পড়ে যে, হিন্দুস্তানের মতো জঘন্যতম প্রতিবেশী কল্পনা করাও দুষ্কর। সেপ্টেম্বর যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের যুদ্ধ বিরতি চুক্তি মেনে নেবার পরও হিন্দুস্তান ক্রমাগত সে চুক্তি লংঘন করে চলেছে, যুদ্ধ বিরতি সীমারেখা অতিক্রম করে তার সামরিক ক্রিয়াকলাপ প্রসারিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আমরা যথাসাধ্য ধৈর্য ও বিবেচনার পরিচয় দিয়ে চলেছি কিন্তু বেশীদিন আমাদের এরকম একতরফা শান্তি প্রচেষ্টা চলতে পারে না। আমাদের বীর। জোয়ানরা, দেশের সর্বস্তরের প্রতি মানুষ, আজ হিন্দুস্তানের সমরলিন্সাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেবার দৃঢ়সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ। আবার যদি বৃহত্তর সংগ্রাম জ্বলেই ওঠে, পাকিস্তান তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এই সত্যটিকে অন্তরের মধ্যে সুস্পষ্ট উপলব্ধি করেই আমাদের বলতে হবে যে, সেপ্টেম্বরের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এই কথাটিকে মনে রেখেই আমাদের সদ্য সমাপ্ত যুদ্ধের আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণায় ব্রতী হতে হবে।’