‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্য-সাহিত্য, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস ও সঙ্গীতের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে নতুন গৌরবে অভিষিক্ত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের অবদান সার্বজনীন। ইসলাম সত্য ও সুন্দরের ঘোষণা করেছে। এই সত্য ও সুন্দরের। পতাকাকে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই, যারা ইসলামের নামে রবীন্দ্রনাথের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছেন তারা আসলে ইসলামের সত্য ও সুন্দরের নীতিতে বিশ্বাসী নন। তাই আমি এই দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারের এই প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৮ জুন ১৯৬৭]
১৮ লেখক-কবি-শিক্ষাবিদের বিবৃতি এবং ভাসানীর বিবৃতির পরই ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, মোহাম্মদ মোহর আলীসহ পাঁচজন অধ্যাপক এক বিবৃতিতে বলেন, তাঁদের ওই বিবৃতিতে ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে এবং তা পাকিস্তানবিরোধী প্রচারে ব্যবহৃত হতে পারে। তারা বলেন, ‘বিবৃতির ভাষায় এই ধারণা জন্মে যে, স্বাক্ষরকারীরা বাংলাভাষী পাকিস্তানি ও বাংলাভাষী ভারতীয়দের সংস্কৃতির মধ্যে সত্যিকারের কোনো পার্থক্য রয়েছে বলে স্বীকার করেন না। বাংলাভাষী-পাকিস্তানিদের সংস্কৃতি সম্পর্কে এই ধারণার সঙ্গে আমরা একমত নই।’
[দৈনিক পাকিস্তান, ২৯ জুন ১৯৬৭]
সরকারি নীতির সমর্থনে আরও ৪০ জন কবি-সাহিত্যিকের বিবৃতি প্রকাশিত হয়। তাতে তাঁরা বলেন, রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই উক্তির প্রতিবাদ করতে আমরা বাধ্য এই কারণে যে, এই উক্তি স্বীকার করে নিলে পাকিস্তানি ও ভারতীয় সংস্কৃতি যে এক ও অবিচ্ছেদ্য এ কথাই মেনে নেয়া হয়।
ওই বিবৃতিতে যে ৪০ জনের স্বাক্ষর ছিল, পরবর্তীকালে জানা গেছে, তাদের সবাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সই করেননি, কেউ করছেন অনুরোধে, কেউ চাকরি বাকরি রক্ষার স্বার্থে চাপে পড়ে। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে প্রভাবশালী ছিলেন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাঁ, বিচারপতি আবদুল মওদুদ, মুজিবর রহমান খা, কবি বেনজীর আহমদ, কবি ফররুখ আহমদ, কবি আহসান হাবীব, কাজী দীন মোহাম্মদ, আ ন ম বজলুর রশীদ, আশরাফ সিদ্দিকী, হাসান জামান প্রমুখ। বিবৃতি প্রকাশের পরদিন আহসান হাবীব, তিনি তখন প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান-এর সাহিত্য সম্পাদক, তার এক ভায়রা জিয়াউল হকের কমলাপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আমি সেখানে ছিলাম। তিনি খুবই বিব্রত বোধ করেন। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মাত্র দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। তার একটির লেখক ছিলেন অনিলচন্দ্র ঘোষ এবং অন্যটির আ ন ম বজলুর রশীদ। তাঁর রবীন্দ্রসংগীত বিরোধিতার কারণ থাকতে পারে না। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রধারার একজন কবি ও রবীন্দ্রপ্রেমিক। তখন তিনি ছিলেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের বাংলা সাহিত্যের প্রফেসর। স্বাক্ষর না করে সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি ছিলেন একজন সরল-সজ্জন প্রকৃতির মানুষ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রকাশিত হয় বজলুর রশীদের জীবনবাদী রবীন্দ্রনাথ নামের একটি বড় বই।
খুব বড় প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব ছাড়া সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। পূর্ব বাংলায় ব্যবহারিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথিকৃৎ মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের বা সায়েন্স ল্যাবরেটরিজের পূর্বাঞ্চলের পরিচালক ছিলেন। সরকারি বাংলা উন্নয়ন বোর্ডেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে তাঁর ভূমিকা ছিল শক্ত। তাঁর পুত্রবধূ খালেদা মঞ্জুর-ই-খুদা ছিলেন বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলসংগীত শিল্পী। সেকালে শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রায় কেউই সৎসাহসের পরিচয় দিতে পারেননি। সেদিক থেকে আমরা ব্যতিক্রম দেখেছি রাজনীতিবিদ ও ইসলামি চিন্তাবিদ আবুল হাশিম, তাঁর পুত্র বদরুদ্দীন উমর এবং Islamic Culture and Philosophy শীর্ষক অসামান্য গ্রন্থের লেখক দর্শনতত্ত্ববিদ অধ্যক্ষ সাইঁদুর রহমানকে। অধ্যক্ষ সাইঁদুর রহমান প্রকাশ্যেই সিন্ধু হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি কায়ানির মতো হাস্যরস করে আইয়ুব সরকারের সমালোচনা করতেন। অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি কথা উল্লেখ করতে হয়। বাম প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের নানাভাবে সাহায্য করতেন তিনি। ন্যাপের এলিফ্যান্ট রোডের অফিস নির্মাণের সময় শুধু নগদ অর্থ নয়, ঠিকাদারদের থেকে ইট-সিমেন্ট জোগাড় করে দিয়েছেন অধ্যক্ষ সাইঁদুর রহমান এবং ডাক্তার এম এ ওয়াদুদ। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরাও তাদের আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হননি। স্বৈরশাসনের সময় সেটা কম সৎসাহসের কাজ নয়।
রবীন্দ্রসংগীতের বিরোধিতায় যারা সরকারকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাঁদের নানাভাবে কটাক্ষ করে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে। তাতে তাদের কেউ কেউ কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলার মতো সাহস তাদের ছিল না। বাঙালি লেখক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটি শ্রেণির নিজেদের অধিকতর প্রগতিশীল বলে জাহির করার একটি প্রবণতা রয়েছে। গত ৪৫ বছরে রবীন্দ্রবিরোধিতার প্রসঙ্গটি অব্যাহত উচ্চারিত হচ্ছে।
তিন
পাঞ্জাবের শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ধারণা ছিল, পাকিস্তানের জন্য দরদ শুধু তাঁদেরই; বিশেষ করে জনসংখ্যার দিক থেকে রাষ্ট্রের বৃহত্তর অংশ পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের ভালোবাসা দেশের জন্য বিশেষ নেই; তারা ভুলে থাকতে চাইতেন যে সত্য তা হলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জনগণের ভোটে এবং সেই ভোটারের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাঙালি মুসলমান। শুধু মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং পাঞ্জাবি রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের কৃতিত্ব নয়। তাই পাকিস্তানি শাসকেরা গভীর দেশপ্রেম থেকে একাত্তরে গণহত্যা ঘটিয়ে ‘অ দেশপ্রেমিক’ বাঙালিদের রক্তে সয়লাব করেন বাংলার পলিমাটি। পাকিস্তানের অসামরিক নেতা ও বীর জেনারেলদের প্রয়োজন ছিল মাটির– মানুষ নয়।