ভারতের আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথের গান যত সম্প্রচারিত হতো, সে তুলনায় রেডিও পাকিস্তান ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী কেন্দ্র থেকে কম হতো। তবে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা ও অন্যান্য কেন্দ্র থেকে সকালে ও সন্ধ্যায় রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশিত হতো। পঞ্চাশের দশকে বিলকিস নাসিরুদ্দিন, মালেকা আজিম খান, আফসারী খানম, ফরিদা বারী মালিক প্রমুখ রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ষাটের দশকে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন আরও অনেকে– নারী ও পুরুষ শিল্পী। সাধারণত যিনি সকালে গাইতেন তিনিই সন্ধ্যায়ও রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করতেন। যুদ্ধের সময় অলিখিতভাবে সরকার নির্দেশ দেয় রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন বন্ধ করতে। বিষয়টি সে রকমভাবে কেউ খেয়াল করেনি বা করলেও তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন বোধ করেনি। যুদ্ধের মতো জরুরি অবস্থায় অনেক কিছুই মানুষ মেনে নেয়। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরও যখন কয়েক মাস রবীন্দ্রসংগীত সম্প্রচার বন্ধ থাকে, তখন সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে বিষয়টি আলোচ্য হয়ে ওঠে। এর মধ্যে আসে পঁচিশে বৈশাখ, সেদিন খুব সামান্য রবীন্দ্রসংগীত ঢাকা, চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত হয়, কিন্তু সেটাও শাসকশ্রেণির বিরক্তির কারণ ঘটায়। ১৯৬৭ র জুনে বিরোধী দলের সদস্যের প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন জাতীয় পরিষদে বলেন, পাকিস্তানের কালচারাল ভ্যালুজের বা পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী রবীন্দ্রনাথের গান রেডিওতে সম্প্রচারিত হবে না। তিনি সেই সঙ্গে এ কথাও যোগ করেন যে শুধু রবীন্দ্রসংগীত নয়, যেকোনো গান, যা পাকিস্তানের নীতি-আদর্শের পরিপন্থী, তা প্রচার বন্ধ থাকবে। কেন্দ্রের যোগাযোগমন্ত্রী খান আবদুস সবুর খানও ওই ধরনের মন্তব্য করেন।
শুধু পাকিস্তানের নয়, যেকোনো রাষ্ট্রেরই আদর্শের পরিপন্থী কোনো কিছুই সে দেশের সরকারি প্রচারযন্ত্র থেকে প্রচারিত হবে না, সেটা সাধারণ বুদ্ধির কথা। ভারত রাষ্ট্রের আদর্শের পরিপন্থী কোনো কিছু আকাশবাণী থেকে যদি সম্প্রচারিত না হয়, তাতে ভারত সরকার ও আকাশবাণী কর্তৃপক্ষকে দোষ দেওয়া যায় না। আকাশবাণী থেকে নজরুলের হামদ্-নাত্ নয়, কীর্তন ও শ্যামাসংগীতই প্রচারিত হতো, তাতে বলার কী থাকতে পারে। এদিকে পাকিস্তান রেডিও থেকে শ্যামাসংগীত নয়, নজরুলের ইসলামি গান ও হামদ-নাত পরিবেশিত হতো, তা নিয়ে বাগবিতণ্ডা করা অর্থহীন। পাকিস্তান-ভারত বৈরিতার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে টানাটানি ছিল পাকিস্তানের নেতাদের নির্বুদ্ধিতা ও গভীরতম সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রকাশ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমনকি ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে বিপুল রবীন্দ্রসাহিত্যের কোথাও একটি শব্দও নেই। বরং তাঁর হিন্দুসমাজে তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।
সরকারি বেতারে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার সীমিতকরণ বা বন্ধের সংবাদে সবচেয়ে ক্ষুব্ধ হন জসীমউদ্দীন। তিনি কমলাপুরে তার ‘পলাশবাড়ীতে আমন্ত্রণ জানিয়ে কয়েকজন প্রবীণ লেখক-বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের মধ্যে বিজ্ঞানী মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদাও ছিলেন। ড. খুদাও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা করে জসীমউদ্দীন এক বিবৃতিতে বলেন :
‘…রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষীদের নাড়ির বন্ধন। কোনো সরকারি আইনের সহায়তায় সে বন্ধন ছিন্ন করা যাবে না। পূর্ব বাংলার বেতার থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার বন্ধ হলে জনগণ রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য আকাশবাণী শুনবে।’
লক্ষ করার বিষয়, প্রথাগত বিবৃতির চেয়ে জসীমউদ্দীনের এই বিবৃতির বক্তব্য ছিল কিছুটা ভিন্ন। অল্প কথায় সরকারকে ঘায়েল করা হয় এবং সরকারি নীতিনির্ধারকদের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া হয় যে তোমাদের রেডিও কেউ শুনবে না, তার পরিবর্তে তোমাদের শত্রু ভারতের বেতারই বাংলাদেশের মানুষ শুনবে এবং সে শোনা তোমরা বন্ধ করতে পারবে না।
একই দিনে ১৮ জন কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ রবীন্দ্রসংগীত প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে এক বিবৃতি দেন। তারা বলেন :
‘…রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তার সঙ্গীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষ্ণতা দান করেছে, তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। সরকারি নীতিনির্ধারণের সময় এই সত্যের গুরুত্বকে মর্যাদা দান করা অপরিহার্য।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা, কাজী মোতাহার হোসেন, সুফিয়া কামাল, জয়নুল আবেদিন, এম এ বারী, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, খান সারওয়ার মুরশিদ, সিকান্দার আবু জাফর, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আহমদ শরীফ, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
বক্তব্যটি এসেছিল যেহেতু মন্ত্রী বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মুখ থেকে, শাহাবুদ্দীন ছিলেন একজন মুসলিম লীগের নেতা, তাই অন্যান্য দলের রাজনৈতিক নেতাদের থেকেই প্রতিক্রিয়া আসা উচিত ছিল। কিন্তু বাঙালি রাজনৈতিক নেতারা নিশুপ রইলেন, যার অর্থ মৌনতাসূচক সম্মতি। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে। দলের নেতাদের মধ্যে যারা বাইরে ছিলেন, তাঁদের কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রস্টেট অপারেশন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেন, রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ওপর আঘাত। রোগশয্যা থেকে তিনি এক বিবৃতিতে বলেন: তথ্যমন্ত্রী শাহাবুদ্দীন ঘোষণা করেছেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত ইসলাম ও পাকিস্তানের ঐতিহ্যপরিপন্থী বিধায় আর বেতার ও টেলিভিশন মারফত পরিবেশিত হবে না। কিছুদিন পূর্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সবুর খানও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনুরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তাঁদের এই বক্তব্য পাকিস্তান সরকারের মনোভাবের প্রকাশ কিনা, ইহাই সরকারের নিকট আমার জিজ্ঞাস্য।