‘কেবল একটি ব্যতিক্রম। সকালে দশটায় খবর পাওয়া গেল, পিআইএ-র যে বিমান করাচী থেকে ঢাকা আসছিল, তা করাচীতে ফিরে গেছে। ভারতের ওপর দিয়ে পিআইএ-র বিমান চলাচল নিষিদ্ধ হয়ে গেছে আজ সকাল থেকে। আকস্মিক অপ্রত্যাশিত এই ছোট খবরের পেছনে যে কি গুরুতর কারণ লুকিয়ে ছিল, ঢাকার মানুষ তখনও তা জানতে পারেনি।
‘সেদিন করাচী থেকে পিআইএ-র বিমানে যারা ঢাকা আসছিলেন, তাদের মধ্যে সদ্য বিদেশ প্রত্যাগত একজন ছাত্রও ছিলেন। তার বৃদ্ধ পিতা পিআইএ-র অফিসে টেলিফোন করে বিমান না আসার অশুভ সংবাদ পেলেন। দীর্ঘ দু’বছর পরে ফিরে আসছে তাঁর ছেলে। সেদিন তিনি অতি ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে নিজে বাজারে গিয়েছিলেন, ছেলের জন্য বিশেষ রান্না হবে-তার সওদা করতে। তার মন শংকিত হয়ে উঠল। দিশেহারা হয়ে তিনি টেলিফোন করলেন এক দৈনিক পত্রিকার দফতরে। যা শুনলেন –তা তাঁকে স্তম্ভিত-হতবাক করে দিল। ভারত বিনা যুদ্ধ ঘোষণায় আজ ভোরে লাহোরে আক্রমণ করেছে। ওয়াজিরাবাদে একটি দাঁড়ানো যাত্রীবাহী রেলগাড়ির ওপর ভারতীয় বিমান বোমা বর্ষণ করেছে। পত্রিকা দফতর থেকে আরও জানা গেল, প্রেসিডেন্ট আজ দুপুর দেড়টায় জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দিচ্ছেন।
‘স্নেহপরায়ণ পিতা, যারা বাৎসল্য ভরা চোখ তাকিয়েছিল পুত্রের আগমন পথের দিকে, সেই চোখে জ্বলে উঠল আগুন। ভারতের এ আক্রমণ-পৃথিবীর ইতিহাসে এক তুলনাহীন চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতার নজির।…
‘ততক্ষণে সারা শহরে বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এই সংবাদ। ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে জাতি। কি দুঃসাহস এই পররাজ্য লোভী হিংস্র বর্বর ভারতের। একে একে হায়দ্রাবাদ, জুনাগড়, মানভাদার, গোয়া দখল করে কাশ্মীরের জনসাধারণের প্রতি দেয়া ওয়াদা খেলাফ করে পায়ের নিচে তাদের পিষে মারবার ঘৃণ্য আয়োজন করেও ক্ষুধা মেটেনি ভারতের। সে এখন পাকিস্তানের পবিত্র ভূমিতে তার নখর বিদ্ধ করেছে। দুপুর দেড়টার অনেক আগে থেকেই যেখানে যত রেডিও সেট ছিল, সবগুলো ঘিরে দাঁড়াল মানুষ। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে-ক্রোধ প্রশমিত করে-হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে রেডিও সেটের চারপাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে পথচারী, কুলি, মজুর, ব্যবসায়ী, কেরানি, অফিসার, ছাত্র, শিক্ষক। যে যে কাজে আছে, সব এই মুহূর্তে তুচ্ছ হয়ে গেছে। কান পেতে রয়েছে কখন প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন।
‘বেজে উঠল জাতীয় সঙ্গীত। জনতা দাঁড়ালো আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে। যারা তখনও এসে পৌঁছুতে পারেনি-তারা দ্রুত পায়ে বাড়িয়ে তুলল ভীড়। পথের মোড়ে মোড়ে পান দোকানের সেটের চারপাশে পঞ্চাশ একশ-দু’শ করে তোক দাঁড়িয়ে আছে। অফিসে সেদিন অফিসারের কামরায় তিল ধারণের জায়গা নেই। বাড়িতে বাড়িতে রান্না ফেলে মা-বোনেরা হলুদ মাখা হাতে রেডিও সেটের সামনে এসেছে। যে ছোট ছেলেটা খেলা ছাড়া আর কিছু বোঝেনা-সেও বড়দের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে উৎকর্ণ হয়ে। প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ শোনা গেল—”আমার প্রিয় দেশবাসী, আজ দশ কোটি পাকিস্তানির জন্য অগ্নিপরীক্ষার সময় এসেছে।” জনতা শুনল পাকিস্তানের ওপরে ভারতের অতর্কিত আক্রমণের কথা। মুহূর্তে রচিত হয়ে গেল জ্বলন্ত ইতিহাস-যখন প্রেসিডেন্ট বললেন, “লাহোরের নির্ভীক বীর জনসাধারণ সর্বপ্রথম শত্রু মোকাবিলা করার সুযোগ পেয়েছে। শত্রুদের চরম আঘাত হানতে পেরেছে বলে ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম অমর হয়ে থাকবে। আর তার পরমুহূর্তেই প্রেসিডেন্ট উচ্চারণ করলেন, “পাকিস্তানের দশ কোটি মানুষের হৃদয়ে ‘লা-ইলাহা-ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’, এই ধ্বনি স্পন্দিত। ভারতের কামান চিরতরে স্তব্ধ না করা পর্যন্ত দশ কোটি পাকিস্তানি বিশ্রাম গ্রহণ করবে না।”
‘৬ই সেপ্টেম্বর ঠিক প্রথাগত গল্প নয়– আলেখ্যবিশেষ। বর্ণনায় বাস্তব প্রতিফলিত হয়েছে। পাক্ষিক এলান-এ প্রকাশিত সৈয়দ শামসুল হক রচনাটি শেষ করেছেন এভাবে :
‘প্রেসিডেন্টের ভাষণ শেষে আবার বেজে উঠল জাতীয় সঙ্গীত। জনতা তখনও অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ নতুন দৃপ্ত, মহীয়ান মনে হচ্ছে, এই সুর। তাঁর প্রতিটি ধ্বনি যেন ডাক দিচ্ছে-”জাগো জাগো জাগো।” বলছে “এগিয়ে যাও, আমি তোমার স্বদেশ, আমি তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, আমাকে রক্ষা করো, শত্রুকে আঘাত হানো।” জাতীয় সঙ্গীতের শেষ ধ্বনি বাতাসে মিলিয়ে গেল। ধীরে ধীরে জনতা চলতে লাগল। ফিরে গেল যে যার কাজে, যে যার গন্তব্যের দিকে। আকাশে প্রখর রৌদ্র, তাদের পদক্ষেপে প্রতিজ্ঞার ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে। আমরা সে দিন বিশ্বের এক মহান দৃশ্য দেখেছি। আমরা দেখেছি, যে জনতা রেডিওর চারপাশে ভীড় করে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের এক আশ্চর্য রূপান্তর। এক কঠিন স্বাজাত্য চেতনা, স্বদেশ প্রেরণা আর দুর্জয় সাহস তাদের প্রত্যেককে উন্নততর একেকটি সজীব মানুষে পরিণত করে দিয়ে গেছে ৬ সেপ্টেম্বর।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে লেখকেরা এ জাতীয় লেখাকে অস্বীকার করেন অথবা গোপন করে যান। কলকাতা সফরে গিয়ে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন কে কত বেশি ভারতপ্রেমিক ও অসাম্প্রদায়িক ছিলেন।
দুই
পঁয়ষট্টিতে যুদ্ধটা বেধেছিল পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে, রণাঙ্গনে লড়াই করেছেন দুই দেশের সব বাহিনীর সদস্যরা, পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতায় ছিলেন দুই দেশের রাজনৈতিক নেতা ও কূটনীতিকেরা। কোনো মৃত ব্যক্তি কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। ওই যুদ্ধের পুরো দুই যুগ আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গত হন। তাঁর পরলোকগমনের ছয় বছর পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের নাগরিক। সাতচল্লিশ-পূর্ব উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের যেকোনো কিছুর অভিন্ন উত্তরাধিকারী ভারত ও পাকিস্তান। লালন শাহ হোন বা আবদুল লতিফ ভিটাই হোন, কিংবা গালিব, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল, নজরুল দুই রাষ্ট্রেরই সম্পদ। দুই দেশেরই উর্দুভাষীদের প্রিয় কবি গালিব ও ইকবাল এবং উপমহাদেশের বাংলাভাষীদের পরম প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। এ নিয়ে কোনো রকম প্রশ্ন তোলাই, বিশেষ করে তাদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে বিবাদ করা নিতান্তই মূর্খ।