[বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড]
তাসখন্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ১৭ দিন পর যুদ্ধ থেমে গেলেও পাকিস্তানের পত্রপত্রিকা ও রেডিওতে ভারতবিরোধী প্রচারণা অব্যাহত থাকে অনেক দিন। সে অস্বাভাবিক নয়। ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধের পর বহু বছর চীনের বিরুদ্ধে ভারতীয় পত্রপত্রিকা অব্যাহত লিখেছে। দেশ পত্রিকায় লেখা হতো ‘ড্রাগনের দাঁতে বিষ’ শিরোনামে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে শান্তি স্থাপন করেন। কিন্তু পাকিস্তানের কবি সাহিত্যিকেরা এমন গল্প-কবিতা-নাটক-প্রবন্ধ প্রভৃতি লিখতে থাকেন, যাতে শুধু ভারতের সমালোচনা নয়, প্রকাশ পায় সাম্প্রদায়িকতা– যেন যুদ্ধটা হয়েছে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে। হিন্দুবিরোধী লেখা লিখে পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিকেরা কেন্দ্রীয় সরকারের আনুকূল্য পেয়েছেন অনেক দিন। আইয়ুব খান বাঙালি কবি সাহিত্যিকদের পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রণাঙ্গন ঘুরে এসে হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছিলেন তাঁর সফরনামা সীমান্ত শিবিরে, যা দৈনিক পাকিস্তানে (পরে দৈনিক বাংলা) ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। আইয়ুব পশ্চিম পাকিস্তানে ঘুরিয়ে দেখতে যাদের নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ উচ্ছ্বসিত সফরনামা লিখেছেন।
রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে তখন একটি রম্য অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো, যা শ্রোতারা উপভোগ করলেও তাতে প্রচারিত হতো হিন্দুবিদ্বেষ। প্রবাসী হিন্দুদের সব সম্পত্তি সরকার অধিগ্রহণ করে এবং তাঁর নাম দেওয়া হয় ‘শত্রুসম্পত্তি’, যে আইনের অভিশাপ থেকে হিন্দুরা আজও মুক্তি পাননি। হিন্দু লেখকদের মুসলমান ও ইসলামবিরোধী রচনার অংশবিশেষ রেডিও থেকে সম্প্রচারিত হতো, যদিও যুদ্ধটা মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের ছিল না, ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের। হিংটিংছট’ অনুষ্ঠানে গুরু-শিষ্যের সংলাপে সম্প্রচারিত হতো জীবন্তিকা। তাতে অংশ নিতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য যা-ই হোক, তার মান খারাপ ছিল না। চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে একটি পুঁথিপাঠের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো, পাঠ করতেন বেলাল মোহাম্মদ।
যুদ্ধ-পরবর্তী কয়েক মাসে প্রধান কবিদের অনেকেই বহু দেশাত্মবোধক গান লেখেন, যা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। যেমন ফররুখ আহমদ জিন্নাহকে স্মরণ করে লিখেছিলেন :
তুমি চেয়েছিলে মুক্ত স্বদেশ ভূমি
তুমি চেয়েছিলে এ বিরান মাঠে
ফসলের মৌসুমী।
শামসুর রাহমানের একটি গান একসময় খুবই গীত হতো :
কালের সে তিমিরে দিল কে আলোর পায়রা
কার সে আভাসে এসেছে আলোর পায়রা।
মহিমার ইংগিত জানা নেই।
পঙ্কিল পথে যেতে মানা নেই,
জানি তবু বাতাসে ভেসেছে
আলোর পায়রা।
আহসান হাবীবের একটি গান এ রকম :
নতুন স্বপ্ন সুষমা জড়ানো
আমরা এনেছি নতুন দিন।
আমরা এনেছি নব জীবনের
নতুন প্রভাত রাঙা রঙিন ॥
আমরা এনেছি নতুন আকাশে নীল বিথার
বেঁধেছি নতুন সুরে জীবনের ছিন্ন তার,
নব গৌরবে জাগে নতুন ফসল নয়া জমীন।
যুদ্ধের সময় আহসান হাবীব লিখেছিলেন সৈনিকদের উদ্দেশে :
দুর্গম এ যাত্রা পথের
কোনো বাঁধা মানবো না
না না না।
আহসান হাবীব গীতিকার ছিলেন না। কিন্তু তখন বেশ কিছু গান লিখেছেন। তাঁর আরেকটি গান :
এলো রে ভয়ের পাখায় পাড়ি দেবার দিন
এলো রে,
জীবনে এলো আবার নতুন জোয়ার
নতুন ভোরে।
তালিম হোসেন লিখেছিলেন বেশ কিছু গান, যেমন–
না, না, না, দুশমনকে দেব না ছুঁতে সীমানা
সইব না সইব না দানবের হানা–।
সিকান্দার আবু জাফর লিখেছিলেন :
নয় নয় আমাদের কোনো সংশয় নয়
আমাদের কারো চোখে মৃত্যুর ভয় নয়।
শামসুর রাহমানের একটি গান ছিল এ রকম :
আজ নয় দ্বিধা, আজ নয় কোনো শোক,
অগ্নিশপথে জ্বলে অগুনিত চোখ?
শুধতেই হবে মাতৃভূমির ঋণ।
যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ৬ সেপ্টেম্বর। যুদ্ধ নিয়ে অনেক কথাশিল্পী গল্পও লিখেছেন, কাব্যনাট্য লিখেছেন, কবিতা-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে প্রচুর। সৈয়দ শামসুল হকের একটি গল্পের নামই ‘৬ই সেপ্টেম্বর’– তাতে তিনি ওই দিনের মানুষের অনুভূতি তুলে ধরেছেন। তখন তাঁর গদ্যের ভাষা ছিল অপেক্ষাকৃত কম অলংকারবহুল ও সরল। গল্পটির আরম্ভ এ রকম :
‘জাতির জীবনে দুর্যোগ আসে অভিশাপ হিসেবে নয়, অগ্নিপরীক্ষার পরম মুহূর্ত হিসেবে। সে মুহূর্ত বারবার আসে না, কিন্তু তার স্মৃতি সর্বমুহূর্তের। নব নব উপলব্ধি আর উদ্বোধনে সে স্মৃতিচারণ জাতীয় জীবনে অমূল্য হয়ে থাকে।
‘সেপ্টেম্বরের ছ’ তারিখ-সোমবার-ঢাকা। এটা ছিল নির্মল ঝরঝরে দিন। রোদ ছিল-গ্রীষ্মের তাপ ছিল বাতাসে। দু’এক টুকরো সাদা মেঘ, তাছাড়া আকাশ ছিল নীল। স্কুল-কলেজে বেরিয়ে পড়েছে ছেলেমেয়েরা। অফিস আদালত বসেছে। দোকানপাট খুলে গেছে। স্টেশনে ট্রেন এসেছে। সদরঘাটে দূর গ্রাম থেকে মোটর লঞ্চ বয়ে নিয়ে এসেছে যাত্রী। বাস চলেছে রৌদ্র-ঝলসিত পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানীতে কর্মের চাঞ্চল্য। জীবনের স্পন্দন অনুভব করা যাচ্ছিল যে কোনো দিনের মতো সেদিনও-সেপ্টেম্বরের ছ’ তারিখ।