যা হোক, রোমান হরফে বাংলা লেখা কারা সমর্থন করেন, সে সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নেয়। সে মতামত জরিপ করা হয় প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে। যেমন প্রশ্ন : পাকিস্তানে (বাংলা ও উর্দু ভাষাতে রোমান হরফ আপনি অনুমোদন করেন কি? এই প্রশ্নের উত্তরে মুহাম্মদ এনামুল হক লিখিত জবাব দেন:
‘ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে এ প্রস্তাব অযৌক্তিক এবং জাতি হিসেবে পাকিস্তানীদের জন্যে এ আত্মঘাতী। এ প্রস্তাব গ্রহণ করলে আমরা লাভবান হবো যৎসামান্য কিন্তু জাতির উন্নতির সহায়ক এমন অনেক কিছুই আমরা হারাবো।
কেন রোমান অক্ষর প্রচলন হবে আত্মঘাতী ও অযৌক্তিক, তার ব্যাখ্যায়। এনামুল হক বলেন :
‘(ক) পাকিস্তানের মত রাষ্ট্রে যেখানে বহুসংখ্যক ধর্ম, ভাষা এবং হরফ বিদ্যমান তার জাতীয় ঐক্যের কথা চিন্তা করা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু তা অবাস্তব। বর্তমান পৃথিবীর বহুধর্মাবলম্বী এবং বহুভাষাভাষী রাষ্ট্রগুলি আজ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে যে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকদের সমন্বয়ে এক রাষ্ট্র বা এক জাতি গড়ে তোলা সম্ভব। পক্ষান্তরে এক ধর্মাবলম্বী এবং এক ভাষাভাষী লোকেরাও পৃথক পৃথক রাষ্ট্রের নাগরিক। (খ) কোনো বিশেষ হরফ বহুভাষাভাষী কোনো রাষ্ট্রে ভাষাগত ঐক্য আনতে পারে না। ভাষা না জানলে শুধু শুনে অথবা কোনো বিশেষ হরফে পড়ে তা কারো বোধগম্য হবে না। একই হরফে দুটি বা তারও বেশী ভাষা লেখা হলে, তা পড়তে পারলেও ভাষাজ্ঞান না থাকলে কারো ভাষাগত বুৎপত্তি কিছুমাত্র বাড়বে না। … (ঙ) মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলি রোমান। হরফ গ্রহণ না করলে, ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান তা করতে পারে না, করা উচিতও নয়।’
[সমকাল, এপ্রিল ১৯৫৯]
এনামুল হক পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শের বিরোধী ছিলেন না। যেকোনো সাধারণ বুদ্ধির মানুষই এনামুল হকের এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এক যুগ বাংলা ভাষার ‘সংস্কারে’র নামে এ জাতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। শুধু কেন্দ্রের অবাঙালি সরকার যদি এই সংস্কারের মতলব করত, তাহলে ছিল এক কথা, বাংলা ভাষা আরবি হরফে বা রোমান অক্ষরে লেখার বুদ্ধি বহু বাঙালি বুদ্ধিজীবীরও মস্তিষ্কপ্রসূত। বাঙালি শিক্ষিত সমাজের একটি গোত্র চিরকাল শাসকশ্রেণির অন্ধ অনুগত হিসেবে সহযোগিতা দিয়ে এসেছে। শাসকদের অন্যায্য তৎপরতার বিরোধিতা না করে সহযোগিতা করেছে জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে। তবে যারা সরকারের সহযোগী ছিলেন না, অরাজনৈতিক ভাবাপন্ন কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক শিক্ষাবিদ, তাঁরাও বাঙালি সংস্কৃতির স্বার্থবিরোধী অপতৎপরতায় সাবলীলভাবে বিরোধিতা করেননি। বাংলা ভাষা নিয়ে যখন সূক্ষ্ম ও স্থূল দুই রকম ষড়যন্ত্রই চলছিল, তখন প্রধান কবি-সাহিত্যিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
দুটি কারণে রোমান হরফে বা আরবি অক্ষরে বাংলা লেখার পরিকল্পনাকে উৎসাহিত করা হয়। এক. বাংলা ভাষাকে ইসলামীকরণ এবং দুই. পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে যেন পূর্ব বাংলার সাহিত্যের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় কারণটি ছিল রাজনৈতিক এবং প্রথমটি ছিল ধর্মীয়। সমর্থন ছিল বহু বাঙালি লেখক ও বুদ্ধিজীবীর।
০৭. সেপ্টেম্বর যুদ্ধ : বাঙালি কবি-সাহিত্যিক
এক
কোনো দেশের লেখক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তির সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটে যুদ্ধবিগ্রহ অথবা ওই রকম কোনো দুর্যোগ বা বড় ঘটনার সময়। ১৯৬৫-র সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৭ দিন এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যখন যুদ্ধ বাধে, তখন দলমত-নির্বিশেষে দেশরক্ষাটাই সবার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, কেউই বৈদেশিক শক্তির পক্ষ নিতে পারে না। নিলে তাকে বলা হবে দেশদ্রোহী, যা সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পঁয়ষট্টির পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময়ও বিরোধী দলের নেতারা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের সরকারের পাশে থাকেন। তাঁর আহ্বানে সবাই তাকে সমর্থন দেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মওলানা ভাসানী, আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, সুফিয়া কামাল, আবুল হাশিমসহ প্রায় সব প্রধান কবি-সাহিত্যিক সরকারকে নৈতিক সমর্থন দেন।
আইয়ুব-মোনায়েম ছিলেন শেখ মুজিবের প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তারা যখন সব রাজনৈতিক নেতাদের একটি বৈঠকের আমন্ত্রণ জানান তাতেও সবাই যোগ দেন। মওলানা ভাসানী সভা-সমাবেশ নিয়ে ঢাকার বাইরে ব্যস্ত থাকায় ওই বৈঠকে অংশ নিতে পারেননি, শেখ মুজিব যোগ দিয়েছিলেন। দলীয় নেতাদের থেকে জানা যায়, মোনায়েমের সঙ্গে বসতে ভাসানী অনিচ্ছুক ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ট্রাইব্যুনালের কাছে শেখ মুজিব তাঁর জবানবন্দিতে বলেছিলেন :
‘১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে যে সকল রাজনীতিবিদ ভারতীয় আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন আমি তাঁহাদের অন্যতম। সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পূর্ণভাবে সমর্থন করার জন্য আমি আমার দল ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই।… যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে আমি প্রদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করি এবং দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম ও সাহায্য করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই। যুদ্ধাবসানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রদেশ ভ্রমণকালে আমি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ আমন্ত্রিত হইয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি।’