[মোহাম্মদ ফেরদাউস খান, ‘হরফ সমস্যা’, বাঙলা একাডেমী পত্রিকা, প্রথম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, ১৩৬৪]
সুখের কথা যে পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা কমিটি ১৯৪৯ সালে যে সমীক্ষা চালায়, তাতে ৩০১ জন উত্তরদাতার মাত্র ১৮ জন রোমান হরফের পক্ষে মত দেন এবং বাংলা অক্ষর বজায় রাখার পক্ষে মত দেন ১৮৭ জন। তবে যদি আরও বেশি বা অধিকাংশ উত্তরদাতাই রোমান হরফের পক্ষে মত দিতেন, তাহলেই কি লিপি পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য হতো?
প্রায় ১০ বছর ধরে অল্পবিস্তর রোমান ও আরবি হরফ চালুর বিষয়টি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আলোচিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা কমিশন ১৯৫৭-তে বয়স্কদের শিক্ষা কার্যক্রমে রোমান হরফ ব্যবহারের প্রস্তাব করেছিল। ব্যাপারটি হাস্যকর। বয়স্করা বাংলা ভাষা পড়বেন এক অক্ষরে আর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়বে অন্য হরফে, তার পেছনে কোনো যুক্তি ছিল কি?
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে, সামরিক শাসন জারির আগেই, রোমান অক্ষর প্রচলনের আয়োজনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ধ্বনিতত্ত্ববিদ মুহম্মদ আবদুল হাই তার এক প্রবন্ধে বাংলার পক্ষে লেখেন :
‘সম্প্রতি রোমান হরফে বাংলা লিখবার একটা ধুয়া উঠেছে। কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ রোমান হরফে বাংলা লেখা প্রচলন করবার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। …যদি বাংলা লিপিতে বাংলাভাষা লেখার কোনো ব্যবস্থা না থাকত কিংবা আজই যদি প্রথমবারের মতো বাংলাভাষা লেখার উপায় উদ্ভাবন আমাদের শিক্ষাবিদদের করতে হতো তা হলে শুধু রোমান কেন, জীবজন্তুর ছবির সাহায্যে কিংবা আরবি অক্ষরেও বাংলা লিখবার সোপারেশ তারা করতে পারতেন। ..কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য বলতে পারি না, গত হাজার বছর ধরে বাংলা লিপিতে বাংলাভাষা লেখা হয়ে আসছে। ফলে বাংলা লিপি বাংলাভাষার ধ্বনির বাহক হিসেবে ক্রমে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। …এখানে বাংলা লিপির বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব এই যে তা অত্যন্ত ধ্বনিভিত্তিক।’ [মুহম্মদ আবদুল হাই, ‘রোমান বনাম বাংলা হরফ, (সমকাল), ২য় বর্ষ, ৮ম সংখ্যা, এপ্রিল ১৯৫৯]
দেশের প্রধান ধ্বনিতাত্ত্বিক অধ্যাপক হাই তাঁর প্রবন্ধে আরও বলেন, ‘…বাংলা হরফ বর্জন করে একেবারে রোমান হরফ গ্রহণ করবার যারা সুপারিশ করেছেন তারা দেশজোড়া Confusion-এর কথা ভেবে দেখেছেন কি? বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বিচার করলে রোমান হরফের তুলনায় বাংলা হরফ যে অনেক বেশী বৈজ্ঞানিক তা সহজেই প্রতিপন্ন হয়। তার কারণ প্রত্যেকটি ধ্বনির জন্য বাংলায় একটি হরফ আছে। “ক” লিখলে “ক” ধ্বনি ছাড়া আর অন্য কিছু উচ্চারণ আমরা করি না এবং কোনো জায়গায় “ক” অনুচ্চারিতও থাকে না। … বাংলা অক্ষর শুধু যে ধ্বনিমূলক (Phonetic) তা নয়, তার চেয়েও এর বড় সুবিধা হলো এই যে, এর স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ একটি করে অক্ষর বা syllable-কে ধারণ করে রয়েছে। …ফলে একটি হরফের সাহায্যে বাংলায় একটি পূর্ণ অক্ষর বা syllable প্রকাশ করা সম্ভব হয়।
বিশিষ্ট ধ্বনিতাত্ত্বিক ও ভাষাবিজ্ঞানী আরও বলেন, বাংলাভাষার ধ্বনিবোধক বাংলা প্রতিলিপি ব্যবহারে এমন “econom” রোমানে তো দূরের কথা পাক ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে অন্য কোনো লিপিতে আছে কিনা সন্দেহ। তা ছাড়া বাংলার যুক্তাক্ষরগুলো ধ্বনির প্রতিলিপি হিসেবে লিপি ব্যবহারের economy-র দিক থেকে বিস্ময়কর শৃঙ্খলাজাত এবং আশ্চর্য রকমের বিজ্ঞানভিত্তিক।
বাংলা ভাষার এত উপযোগিতা ও বাংলা একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ভাষা হওয়া সত্ত্বেও কেন তা সংস্কারের প্রশ্ন ওঠে এবং সমর্থন করেন বাংলাভাষী শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা, তার পেছনে শাসকশ্রেণির যে দুরভিসন্ধি ছিল, তা যেকোনো সাধারণ বুদ্ধির মানুষও উপলব্ধি করতে পারে। মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে পাকিস্তানীকরণ ও ইসলামীকরণ। ১৯৪৯-এর মার্চে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর নেতৃত্বে গঠিত পূর্ববঙ্গ ভাষা কমিটিতে যারা ছিলেন, তাঁরা সবাই ছিলেন রক্ষণশীল ও পাকিস্তানবাদী। ওই কমিটিতে নামেমাত্র রাখা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক গণেশচন্দ্র বসু ও ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিক মোহিনী মোহন দাসকে। ওই কমিটিতে থাকতে গণেশচন্দ্র অস্বস্তিবোধ করেন। তিনি অব্যাহতি চাইলে তার জায়গায় বাংলা বিভাগেরই প্রভাষক হরনাথ পালকে নেওয়া হয়। কমিটির অন্যদের সঙ্গে পালও ছিলেন বেমানান। তিনিও কিছুদিন পর অপারগতা প্রকাশ করেন। তখন একজন হিন্দুকে রাখা প্রয়োজন, তাই জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক অজিত কুমার গুহকে তার জায়গায় যুক্ত করা হয়।
মোহিনী মোহন দাস ছিলেন অতি ভালো মানুষ এবং অসাম্প্রদায়িক। মুসলমানদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে আগ্রার আধ্যাত্মিক সাধক হজরত সেলিম চিশতির নাতি চিশতি বেহেশতির মাজার জরাজীর্ণ হয়ে গেলে মোহিনী দাস তা সংস্কার করে পুনর্নির্মাণ করেন। তাঁকে রাখা হয়েছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে। বছরখানেকের মধ্যে তিনি মারা গেলে তাঁর জায়গায় অম্বিকাঁচরণ দাস নামের একজন শিক্ষা কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে ভাষা-সংস্কৃতির কমিটিতে সংখ্যালঘুদের মতামতের কোনো মূল্যই ছিল না। পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যে কোনো মূল্য নেই, তা ভাষাকে কেন্দ্র করে সরকারের আচরণেই স্পষ্ট হয়ে যায়।