চারটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশের পরও বাংলা একাডেমি অথবা অন্য কোনো পুরস্কার কমিটির দৃষ্টি এড়িয়ে যান তিনি। এখন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটি উচ্চারণ না করে যারা দিন শুরু করেন না, একাত্তরের আগে তারা ওই শব্দ এড়িয়ে যেতেন। বদরুদ্দীন উমরের মতো একজন পণ্ডিত যদি ইসলাম ও মুসলমান বা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ নিয়ে একখানা বই লিখতেন, ষাটের দশকে তিনিও একাধিক পুরস্কার পেতেন। ১৯৭২ সালে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়; কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। উপযুক্ত কাজটিই তিনি করেছিলেন। তিনি অবিচল প্রতিষ্ঠানবিরোধী।
পাকিস্তানি শাসনামলে পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ-কৃষক, শ্রমিক, ছোট চাকুরে, স্কুলশিক্ষক, তাঁতি, কামার, কুমার, জেলে প্রভৃতি শোষণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু সরকারের সঙ্গে সদ্ভাব ছিল যেসব কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পীর, তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ যা-ই হোক, তারা রাষ্ট্রীয় পদক-পুরস্কার যথেষ্টই পেয়েছেন। তারা সরকারি আনুকূল্যে অথবা সরকারি ডেলিগেশনের সদস্য হয়ে শুধু পশ্চিম পাকিস্তান নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। অধ্যাপক-লেখকেরা পাঠ্যপুস্তক লিখে উপার্জন করেছেন প্রচুর। পাঠ্যপুস্তক রচনায় মুনীর চৌধুরী ছিলেন শীর্ষে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বাংলা অনেকগুলো পাঠ্য সংকলনের তিনি সম্পাদক।
আইয়ুব সরকারের সাংস্কৃতিক নীতির যারা রচয়িতা ছিলেন, তাঁদের দু’একজন বাদে সবাই ছিলেন অবাঙালি উর্দুভাষী। তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন উচচপদস্থ সরকারি আমলা। তারা অনেকে পাকিস্তানে এসেছিলেন ভারতের পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশের সংস্কৃতিবান পরিবার থেকে। সংগীত, শিল্পকর্ম, সাহিত্যের কদর তারা বুঝতেন। তাঁরা উঠতি বাঙালি কবি-সাহিত্যিক শিল্পীদের পদক-পুরস্কার দিয়ে মর্যাদা দিতে চাইতেন। সেই সুযোগের ষোলো আনা সদ্ব্যবহার করেছেন পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা।
পুরস্কারের ক্ষেত্রে ষাটের দশক ছিল বাঙালি কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্য স্বর্ণকাল। শুধু বাংলা একাডেমি পুরস্কার নয়, সরকারি আনুকূল্যে প্রবর্তিত হয়েছিল আরও কয়েকটি মর্যাদাবান পুরস্কার, যেমন আদমজী পুরস্কার, দাউদ পুরস্কার, ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তান পুরস্কার, জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা পুরস্কার, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান পুরস্কার, ইউনেসকো সাহিত্য পুরস্কার প্রভৃতি। এসব পুরস্কারের কারণে উন্নতমানের সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা পান লেখকেরা।
০৬. ভাষার প্রশ্নে বাহাস
অত্যন্ত অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বাংলা ভাষা নিয়ে অনাবশ্যক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ করা টাকার সদ্ব্যবহার করার মতো লেখক-শিক্ষাবিদ পূর্ব বাংলায় যথেষ্টই ছিলেন। অবশ্য একই সঙ্গে বিভিন্ন অপপ্রয়াসের বিরোধিতাও করেছেন কেউ কেউ। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি তাদের ভাষার সংস্কার করেছেন সময়ের প্রয়োজনে। ভাষার লিপিও পরিবর্তন করা হয়েছে। আধুনিক তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুর্কি ভাষার লিপি পরিবর্তন করে রোমান হরফ চালু করেন। ভাষা মালয় ও ভাষা ইন্দোনেশিয়ায় রোমান হরফ প্রবর্তন করা হয়েছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ভাষা বাংলার মতো সমৃদ্ধ ছিল না। ওগুলো ছিল উপজাতীয় ভাষার মতো, ছিল না কোনো মানসম্মত সাহিত্য। বাংলা ভাষার ঐতিহ্য হাজার বছরেরও বেশি সময়ের এবং বাংলা ভাষায় সমৃদ্ধ সাহিত্য রচিত হয়েছে ৫০০ বছরের বেশি সময় যাবৎ। বাংলা ভাষার হরফ পরিবর্তনের চিন্তাটাই ছিল অনাবশ্যক এবং চরম আত্মঘাতী।
বাংলা ভাষা আরবি অথবা রোমান হরফে লিখলে পূর্ব বাংলার বাংলা সাহিত্য অন্য দেশের বাংলা সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত যে তা-ই নয়, অতীতের বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে রচিত হতো দূরত্ব। সে এমন এক দূরত্ব, যা বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যকেই ক্ষতি করে দিত এবং সে ক্ষতি হতো অপূরণীয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশ দখল করে ইংরেজদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর বিদেশি শাসকেরা বাংলাসহ ভারতীয় ভাষার হরফ পরিবর্তন করে ইংরেজি বা রোমান অক্ষরে লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। আঠারো শতকের শেষ দিকে স্যার উইলিয়াম জোন্সসহ প্রধান প্রধান ইংরেজ’ কর্মকর্তা ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখার উদ্যোগ নেন। তাদের সে উদ্যোগ ইংরেজদেরই অনেকে সমর্থন করেননি। তবে তখন তার শক্ত বিরোধিতা করারও তেমন কেউ ছিলেন না। পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা চাইলে বাংলা দেশে ইংরেজি চালু করতে পারতেন। কিন্তু তার পরিবর্তে ইংরেজ প্রশাসনের লোকেরাই বাংলা শেখেন এবং খ্রিষ্টান ধর্মযাজকেরা বাংলা গদ্যের বিকাশে ভূমিকা রাখেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কেউ কেউ রোমান হরফে বাংলা লেখার পক্ষে যুক্তি দেন যে বাংলা ভাষায় যুক্তাক্ষর বেশি, যা টাইপরাইটারে লিখতে অসুবিধা এবং রোমান হরফ বাংলার চেয়ে দ্রুত পড়া ও লেখা সম্ভব। আর যে যুক্তিটি দেওয়া হয় তা হলো, রোমান হরফে বাংলা বিদেশিদের পক্ষে শেখা সহজ হবে ইত্যাদি। এসব যুক্তি খণ্ডন করে মোহাম্মদ ফেরদাউস খান তাঁর ‘The Language Problem of Today’ এবং পরে একটি প্রবন্ধে বলেন যে, চীন ও জাপানের শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নতির পথে তাদের জটিল লিপি কোনো বাধা হয়নি। তিনি আরও বলেন, বাংলা যুক্তাক্ষর কোনো সমস্যা নয়।