যথাক্রমে দুই চরণের হরফ-সংখ্যা ১৮, ১৯, অক্ষরসংখ্যা ১৭, ১৬, মাত্ৰাসংখ্যা ২০, ২০।
অনেকে বলেন–মাত্রাবৃত্তে যুক্তব্যঞ্জন ২ মাত্রা। তাতে হিসাব মিলতে পারে, কিন্তু উক্তিটি ভ্রমাত্মক। পল্লব শব্দের ল্ল ২ মাত্রা বললে বোঝায় ম্ল এর অ-কার ২ মাত্রা। কিন্তু তা সত্য নয়, প-এর অ-কারই ২ মাত্রা, কারণ পরে যুক্তব্যঞ্জন আছে। পল্লব এইরকমে অক্ষরভাগ করলে মাত্রাবিপর্যয় ঘটে না। অনুরূপ–উৎ-সা-হ, সংহ-ত, দুঃসহ।
বাংলা মাত্রাবৃত্তের সঙ্গে সংস্কৃত মাত্রাচ্ছন্দের সাদৃশ্য আছে। প্রভেদ এই–বাংলায় ঐ ঔ ছাড়া স্বতদীর্ঘ স্বর নেই। মাত্রাবৃত্তে যদি অক্ষরবিন্যাস ভেদে নিয়মিত করা হয় তবে তার সঙ্গে সংস্কৃত অক্ষরচ্ছন্দের সাদৃশ্য হয়। উদাহরণ শেষে আছে।
স্বরবৃত্ত
রবীন্দ্রনাথ এই শ্রেণীর বাংলা ছন্দের নাম দিয়েছেন–প্রাকৃত ছন্দ। গ্রাম্য ছড়ায় ও গানে প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়। স্বরবৃত্ত নামের উদ্দিষ্ট অর্থ কি ঠিক জানি না। কেউ কেউ বলেন–এতে প্রতি চরণে স্বরবর্ণের (অতএব অক্ষরের) সংখ্যা সমান রাখা হয়। অনেক স্থলে তা হয় বটে, কিন্তু শ্রেষ্ঠ কবির লেখাতেও ব্যতিক্রম দেখা যায় এবং তার জন্য ছন্দঃপাত হয় না। অতএব বলা চলে না যে নিয়ত স্বরসংখ্যাই এই শ্রেণীর লক্ষণ। স্বরবৃত্তের বিশিষ্টতা-মাত্ৰাসংখ্যা ঠিক রাখবার জন্য স্থানবিশেষে কৃত্রিম দীর্ঘ স্বরের প্রয়োগ।
বৃটি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান,
শিব-ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কনে দান।
যথাক্রমে দুই চরণের হরফ-সংখ্যা ১৭, ১৬, অক্ষরসংখ্যা ১৩, ১২, মাত্রাবৃত্তের রীতিতে গণিত মাত্ৰাসংখ্যা ১৮, ১৭। এই হিসাবে দ্বিতীয় চরণে এক মাত্রা কম পড়ে, কিন্তু চিহ্নস্থানে প্রথম চরণে ২টি স্বর এবং দ্বিতীয় চরণে ৩টি স্বর প্রসারিত করায় কৃত্রিমগুরু অক্ষর উৎপন্ন হয়েছে, তার ফলে প্রতি চরণে ২০ মাত্রা হয়েছে। এই ছড়া সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছন্দ পুস্তকে লিখেছেন–তিন গণনায় যেখানে ফাঁক, পার্শ্ববর্তী স্বরবর্ণগুলি সহজেই ধ্বনি প্রসারিত করে সেই পোড়ো জায়গা দখল করে নিয়েছে। অর্থাৎবৃষ্টি ৩ মাত্রা; শেষের এ-কার প্রসারিত করার ফলে পড়েও ৩ মাত্রা।
দিনের আলো নিবে এ-র্ল সু-যি ডো-র্বে ডো-বে,
আকাশ ঘি-রে মেঘ জুটেছে চা-দের লো-র্ভে লো-ভে।
মেঘের উপর মেঘ করেছে, রঙের উপর রঙ।
মন্-দি-রে-তে কাঁসর ঘন্টা বাজল ঠং ঠং।
উপরের ৪ পঙক্তিতে যথাক্রমে হরফ-সংখ্যা ১৫, ১৭, ১৯, ১৬, অক্ষরসংখ্যা ১৪, ১৪, ১৩, ১২, মাত্রাবৃত্তানুসারে মাত্ৰাসংখ্যা ১৬, ১৭, ১৯, ১৮। চিহ্নস্থানে চার পঙক্তিতে যথাক্রমে ৪, ৩, ১, ২, স্বর প্রসারিত করায় প্রতি পঙক্তিতে ২০ মাত্রা হয়েছে। প্রথম ঠং লক্ষণীয়–এখানে প্রসারণ ও অনুস্বার এই দুই কারণে অ-কার ৩ মাত্রা পেয়েছে।
স্বরবৃত্তের সূত্র-চরণের হরফ-সংখ্যা অনিয়ত, অক্ষরসংখ্যা অনিয়ত, মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত, অক্ষরবিন্যাস অনিয়ত। মাত্রাগণনায় মাত্রাবৃত্তের রীতি অনুসৃত হয়, কিন্তু অতিরিক্ত কৃত্রিমদীর্ঘ স্বরও ধরা হয়। কৃত্রিমদীর্ঘ স্বর (বা কৃত্রিমগুরু অক্ষর) থাকাতেই মাত্রাবৃত্তের সঙ্গে স্বরবৃত্তের প্রভেদ হয়েছে।
উল্লিখিত সংস্কৃত ও বাংলা বিভিন্ন ছন্দঃশ্রেণীর লক্ষণ এই সারণীতে সংক্ষেপে দেওয়া হল–
লক্ষণ
সংস্কৃত
বাংলা অক্ষরচ্ছন্দ মাত্রাচ্ছন্দ। অক্ষরবৃত্ত মাত্রাবৃত্ত স্বরবৃত্ত
নেই।
আছে আছে। নেই : অনিয়ত নিয়ত
নেই
স্বভোগুরু অক্ষর। পরতোগুরু অক্ষর কৃত্রিমগুরু অক্ষর হরফ-সংখ্যা অক্ষরসংখ্যা মাত্ৰাসংখ্যা অক্ষরবিন্যাস
নেই
আছে।
অল্প * অল্প* আছে। অল্প + আছে আছে।
আছে। অনিয়ত। নিয়ত অনিয়ত অনিয়ত প্রায় অনিয়ত অনিয়ত অনিয়ত অনিয়ত নিয়ত নিয়ত নিয়ত নিয়ত
অনিয়ত অনিয়ত অনিয়ত অনিয়ত
নিয়ত
নিয়ত
অসম ছন্দ ও গদ্য ছন্দ
পূর্বোক্ত তিন শ্রেণীর বাংলা ছন্দে দেখা যায় যে একচরণের মাত্ৰাসংখ্যা পরবর্তী কোনও এক চরণের সমান। এইরকম দু-একজোড়া চরণ মিলিয়ে দেখলেই ছন্দের শ্রেণী ধরা পড়ে। কিন্তু যেখানে চরণগুলি অসমান সেখানে উপায় কি? শব্দাবলীর মাত্রাভঙ্গী থেকে অনেক স্থলে বলা যেতে পারে যে ছন্দটি অমুক শ্রেণীর। কিন্তু কতকগুলি ছন্দ, বিশেষত গদ্য ছন্দ, তিন শ্রেণীর কোনওটির সঙ্গে খাপ খায় না।
১। আমার দুর্বোধ বাণী
বিরুদ্ধ বুদ্ধির পরে মুষ্টি হানি
করিবে তাহারে উচ্চকিত
আতঙ্কিত
২। অধরা মাধুরী পড়িয়াছে ধরা
এ মোর ছন্দ বন্ধনে।
বলাকা পাঁতির পিছিয়ে পড়া ও পাখি,
বাসা সুদূরের বনের প্রাঙ্গণে।
৩। আমার পক্ষে বিয়ে করা বিষম কঠিন কর্ম,
কিন্তু গৃহধর্ম।
স্ত্রী না হলে অপূর্ণ যে রয়,
মনু হতে মহাভারত সকল শাস্ত্রে কয়।
উদ্ধৃত উদাহরণগুলির ভঙ্গী থেকে বলা যেতে পারে প্রথমটি অক্ষরবৃত্ত, দ্বিতীয়টি মাত্রাবৃত্ত, তৃতীয়টি স্বরবৃত্ত। প্রত্যেকটিতে যেন সমান মাত্রার এক একরকম ছন্দ থেকে এক একটি পঙক্তি তুলে এনে অসমান মাত্রার গোছা বাঁধা হয়েছে। এরকম ছন্দকে মিশ্রছন্দ বলা যেতে পারে। কিন্তু–
সন্ধ্যা এল চুল এলিয়ে
অস্তসমুদ্রে সদ্য স্নান করে।
মনে হল স্বপ্নের ধূপ উঠছে।
নক্ষত্রলোকের দিকে।
এই উদাহরণ একবারে স্বচ্ছন্দ, সাধারণ ছন্দের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। রবীন্দ্রনাথ এরকম গদ্য ছন্দের পরিচয় দিয়েছেন–এতে পদ্যের ছন্দ নেই, এতে জমানো ভাবের ছন্দ। শব্দবিন্যাসে সুপ্রত্যক্ষ অলংকরণ নেই, তবুও আছে শিল্প।