রবীন্দ্রনাথ মনে প্রাণে আধুনিক ও যুক্তিবাদী, তথাপি তার কাব্য নাটক আর গল্পে এদেশের প্রাচীন চিন্তাধারার সঙ্গে যোগসূত্র পূর্ণমাত্রায় বজায় রেখেছেন, তিনি লোকব্যবহারেও যে অনুরূপ যোগসূত্র রেখেছিলেন তার উল্লেখ করে আমার বক্তব্য শেষ করব। রবীন্দ্রনাথ কীর্তি আর আভিজাত্যের গণ্ডি দিয়ে নিজেকে ঘিরে রাখেন নি, কোনও আলাপপ্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করেন নি। তার সাহিত্যের যাঁরা চর্চা করেন, দেশের জনসমষ্টির তুলনায় তাদের সংখ্যা খুব কম, তথাপি শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে অগণিত লোক তার সঙ্গে দেখা করে নিজেকে ধন্য মনে করেছেন। আগন্তুকের সমস্ত সংকোচ একমুহূর্তে দূর করবার আশ্চর্য ক্ষমতা তার ছিল। কার কোন্ বিষয়ে কতটুকু দৌড় তা বুঝে নিয়ে তিনি আলাপ করতে পারতেন। শিক্ষিত অশিক্ষিত ছেলে বুড়ো সকলেই তাঁর সঙ্গে অবাধে মিশেছে, অনেক সময় উপদ্রবও করেছে। তাঁর কাছে ঘোমটাবতী পল্লীবধূর জড়তা দূর হয়েছে, যেমন তীর্থস্থানে হয়। স্থান কাল পাত্র অনুসারে নিজেকে আবশ্যকমত প্রসারিত বা সঙ্কুচিত করবার এই শক্তি তাঁর লোকপ্রিয়তার একটি কারণ। হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কেবা–এই কবিতায় তিনি অজ্ঞাতসারে নিজ স্বভাবের এক দিকের পরিচয় দিয়েছেন।
জন্মশাসন ও প্রজাপালন
পুরাণে আছে, মানব ও দানবের পীড়নে বিপন্না বসুন্ধরা যখন ত্রাহি ত্রাহি রব করতে থাকেন তখন নারায়ণ কৃপাবিষ্ট হয়ে ভূভার হরণ করেন। বৈজ্ঞানিক ভাষায় এই পুরাণোক্তির ব্যাখ্যা করা যেতে পারে কোনও প্রাণিসংঘ যদি পরিবর্তিত প্রতিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে চলতে না পারে অথবা নিজের সমাজগত বিকারের প্রতিবিধান করতে না পারে তবে তার ধ্বংস হয়। এই প্রাকৃতিক নিয়মে পুরাকালের অনেক জীব এবং সমৃদ্ধ মানবসমাজ ধ্বংস হয়ে গেছে।
পৃথিবী এখন একসত্তা, তার একটি অঙ্গ রুগ্ন হলে সর্ব দেহের অল্পাধিক বিকারের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সেকালে এক দেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের যোগ অল্পই ছিল। নেপোলিয়নের আমলে প্রায় সমস্ত ইওরোপ যুদ্ধে লিপ্ত হলেও এশিয়া তাতে জড়িয়ে পড়ে নি। চল্লিশ বৎসর পূর্বে মার্কিন রাষ্ট্র ইওরোপীয় রাজনীতি থেকে তফাতে থাকত। চীন দেশে বা ভারতে দুর্ভিক্ষ হলে বিলাতের বণিক সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হত, কিন্তু জনসাধারণ তার জন্য উৎকণ্ঠিত হত না। বিগত প্রথম মহাযুদ্ধে ভারতীয় প্রজার বিশেষ অনিষ্ট হয়। নি। কিন্তু বিভিন্ন দেশের এই পৃথভাব এখন লোপ পেতে বসেছে। জার্মনি আর জাপানে স্থানাভাব, জীবনযাত্রা ও শিল্পের উপাদানও যথেষ্ট নেই, তার ফলে বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ হল। ভারত আর এশিয়ার অন্যান্য স্থানের দারিদ্র্য দেখে আমেরিকা ব্রিটেন ফ্রান্স প্রভৃতি এখন চিন্তিত হয়ে পড়েছে, পাছে সমস্ত প্রাচ্য দেশ কমিউনিস্টদের কবলে যায়।
বহুদেশের লোকসংখ্যা দ্রুতবেগে বেড়ে যাচ্ছে। কবি হেমচন্দ্রের ভারতভূমি ছিল বিংশতি কোটি মানবের বাস, এখন খণ্ডিত ভারতেরই লোক সংখ্যা ৩৬ কোটি এবং প্রতি বৎসরে প্রায় ৫০ লক্ষ বাড়ছে। পৃথিবীর লোকসংখ্যা ২০ বৎসর আগে প্রায় ১৮৫ কোটি ছিল, এখন ২০০ কোটির বেশী হয়েছে। সমৃদ্ধ দেশের তুলনায় দরিদ্র ও অনুন্নত দেশের প্রজাবৃদ্ধির হার অনেক বেশী, কিন্তু এক দেশে অন্নাভাব আর স্থানাভাব হলে সকল দেশের পক্ষে তা শঙ্কাজনক। পৃথিবীতে বাসযোগ্য ও কৃষিযোগ্য ভূমি এবং খনিজ উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ সম্পদ যা আছে তার যথোচিত বিভাগ হলে সমস্ত মানবজাতির উপস্থিত প্রয়োজন মিটতে পারে, কিন্তু রাজনীতিক ও অন্যান্য কারণে তা অসম্ভব। ভারতের নানা স্থানে বাঙালী পঞ্জাবী ও সিন্ধী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। ব্রিটেন জার্মনি ও ইটালির বাড়তি প্রজাও অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ আফ্রিকা ও কানাডায় আশ্রয় পাচ্ছে, কিন্তু সেসব দেশে ভারতীয় বা জাপানী প্রজার বসতি নিষিদ্ধ। যেখানে প্রচুর তেল কয়লা প্রভৃতি খনিজ বস্তু বা খাদ্যসামগ্রী আছে সেখান থেকে মাল পাঠিয়ে অন্য দেশের অভাব অবাধে পূরণ করা যায় না। পৃথিবী একসত্তা হলেও একাত্মা হয় নি।
প্রায় দেড় শ বৎসর পূর্বে মালথস বলেছিলেন, খাদ্যের উৎপাদন যে হারে বাড়ানো যেতে পারে তার তুলনায় জনসংখ্যা বেশী গুণ বেড়ে যাবে, অতএব জন্মশাসন আবশ্যক, নতুবা খাদ্যাভাব হবে। এদেশের অনেকে মনে করেন, লোকসংখ্যা যতই বাড়ুক তার জন্য আতঙ্কের কারণ নেই, যিনি জীব দিয়েছেন তিনিই আহার যোগাবেন। ভারতে ভূমির অভাব নেই, একটু চেষ্টা করলেই চাষবাসের যোগ্য বিস্তর নূতন জমি পাওয়া যাবে, জলসেক আর সারের ভাল ব্যবস্থা হলে ফসল বহু গুণ বেড়ে যাবে। আর জনসংখ্যার অতিবৃদ্ধি ভাল নয় বটে, কিন্তু তার প্রতিকার সংযমের দ্বারাই করা উচিত, কৃত্রিম উপায়ের প্রচলন হলে ইন্দ্রিয়াসক্তি প্রশ্রয় পাবে। এঁরা মনে করেন উপদেশ দিয়েই জনসাধারণকে সংযমী করা যেতে পারে।
যাঁরা দূরদর্শী জ্ঞানী তারা এই যভবিষ্য নীতি মেনে নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। খুব চেষ্টা করলে কৃষিযোগ্য ও বাসযোগ্য জমি বাড়বে এবং খাদ্য বস্ত্র ও শিল্পসামগ্রীর অভাব মিটবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু খাদ্যবস্ত্রাদি বৃদ্ধির একটা সীমা আছে। যদি বর্তমান হারে লোকসংখ্যা বেড়ে যায় তবে এমন দিন আসবে যখন এই বিপুলা পৃথিবী মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারবে না, বিজ্ঞানের চূড়ান্ত চেষ্টাতেও ফল হবে না। অ্যাটম বা হাইড্রোজেন বোমায় নয়, ভাবী মহাযুদ্ধে নয়, গ্রহনক্ষত্রের সংঘর্ষেও নয়; বর্তমান সভ্যসমাজের রীতিনীতিতেই এমন বিকারের বীজ নিহিত আছে যার ফলে অচির ভবিষ্যতে মানবজাতি সংকটে পড়বে।