কোনও কাব্য নাটক বা গল্পে যদি মতবিশেষের সমর্থন থাকে তাতে আপত্তি করবার কিছু নেই। ললিত সাহিত্যের লেখক অবসরকালে চা সিগারেট বা কেশতৈলের বিজ্ঞাপন লিখতে পারেন, কিংবা তার গল্পের মধ্যেই অহিংসা কংগ্রেসনিষ্ঠা হিন্দুজাতীয়তা বা কমিউনিস্ট আদর্শের প্রশংসা করতে পারেন। লেখক অলেখক নির্বিশেষে রাজনীতিক সংঘ, গোষ্ঠী বা ক্লাব গঠনের অধিকারও সকলের আছে। কিন্তু যাঁরা মতের লেবেল দিয়ে লেখক-সংঘ গঠন করেন, সাধারণে তাদের একটু সন্দিগ্ধভাবে দেখে, মনে করে এঁদের চোখে রাজনীতির ধুলো লেগেছে, এঁরা সত্যসন্ধানী নিরপেক্ষ দৃষ্টি হারিয়েছেন।
রাজনীতিক নাম দিয়ে সাহিত্য-সংঘ গঠনের উদ্দেশ্য ঠিক বোঝ না গেলেও কিছু কিছু অনুমান করা যায়। সাহিত্যসেবীর দলবদ্ধ হয়ে রাজনীতিক লেবেল ধারণ একরকম ব্রত। এই ব্রতধারীদের সংকল্প–এঁরা নিজ নিজ রচনার দ্বারা যথাসম্ভব দলীয় মতের প্রচার এবং বিপক্ষ মতের খণ্ডন করবেন। দল না বেঁধেও এঁরা এই কাজ করতে পারতেন, কিন্তু সংঘের অনুশাসন না থাকলে একনিষ্ঠ সমক্রিয়তা আসে না।
এই দলবন্ধনের ফলে প্রচারের সুবিধা হতে পারে। কিন্তু ললিত সাহিত্যের রচয়িতা পাঠক ও বিচারকের পক্ষে যে নিরপেক্ষতা অত্যন্ত আবশ্যক তা লেবেলের জন্য ব্যাহত হয়। সাহিত্যে বিজ্ঞাপনের গন্ধ এসে পড়ে, মনে হয় লেখকের স্বাধীনতা নেই, তিনি দলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন। যে পাঠক কমিউনিস্ট তন্ত্রের অনুরাগী তিনি কংগ্রেসী লেখকের রচনায় বুর্জোয়া স্বার্থবুদ্ধি দেখতে পান। যিনি কংগ্রেসী পন্থায় বিশ্বাসী তাঁর কাছে মার্কামারা কমিউনিস্ট লেখকের রচনা অবোধ্য বা দুষ্ট অভিসন্ধি যুক্ত মনে হয়। যে লেখক দলভুক্ত না হয়ে স্বতন্ত্রভাবে নিজের মত প্রকাশ করেন তিনি পাঠকবর্গের কাছে অধিকতর সুবিচার পেয়ে থাকেন।
রাজনীতি ছাড়াও অনেক বিষয় আছে যাতে দলগত বিবাদ নেই, যার সঙ্গে দেশের মঙ্গলামঙ্গল অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত, যার গুরুত্ব অন্য সমস্ত বিষয়ের চেয়েও বেশী। কালোবাজার, প্রতারণা, অমানুষিক স্বার্থপরতা ইত্যাদি সম্বন্ধে অনেক লেখা হয়েছে, কিন্তু তা ছাড়াও ছোট বড় যেসব পাপ আমাদের বর্তমান সমাজে মহামারীর মতন ব্যাপ্ত হচ্ছে তার প্রতিবিধানের জন্য সকল সাহিত্যিকই চেষ্টা করতে পারেন।
পূর্বে শোনা যেত যে আমাদের জাতিগত যত দোষ তার মূল হচ্ছে পরাধীনতা, দেশ স্বাধীন হলেই সকল দোষ ক্রমশ দূর হবে। স্বাধীনতা এসেছে কিন্তু দোষ আগের চেয়ে বেড়েই চলেছে, যা পূর্বে ছিল না তাও দেখা দিয়েছে। এই দোষবৃদ্ধির এক কারণ আমাদের রাষ্ট্রশাসনে অভিজ্ঞতার অভাব, তার চেয়ে বড় কারণ যুদ্ধজনিত জগদ্ব্যাপী বিপর্যয়। যে সব পাশ্চাত্ত্য জাতি বহুকাল স্বাধীনতায় অভ্যস্ত তাদেরও নৈতিক অধধাগতি হয়েছে, কিন্তু আমাদের মতন হয় নি। আসল কথা, আমরা যতই ধর্মপ্রাণ জাতি বলে গর্ব করি, আমাদের ধর্মবোধ অর্থাৎ সামাজিক কর্তব্যবোধ বহুকাল থেকেই ক্ষীণ, যেটুকু ছিল যুদ্ধের ধাক্কায় তাও নষ্ট হয়েছে, অনভ্যস্ত প্রভুশক্তি আর নব নব ব্যবস্থার সুযোগ পেয়ে দেশের অনেকে নিরঙ্কুশ স্বার্থসর্বস্ব হয়েছে, অনেক সাধু লোকও অভাবের তাড়নায় বা অপরের দৃষ্টান্তে অসাধু হয়েছে।
সকলের চোখের সামনে নিত্য যে সব অন্যায় ঘটছে তার প্রতিরোধের প্রয়োজন আজ সমস্ত রাজনীতিক বিবাদের উপরে। কংগ্রেস রাজত্বের বদলে সমাজতন্ত্রী হিন্দুমহাসভা কিষান-মজদুর-প্রজা বা কমিউনিস্ট শাসন এলেই আমাদের চরিত্র শুধরে যাবে এমন মনে করবার কোনও কারণ নেই। আমাদের বর্তমান দুর্দশার অনেকটার জন্য আমরা দায়ী নই তা ঠিক, কিন্তু যে দোষ আমাদের প্রকৃতিগত, তার প্রতিকার আমাদেরই হাতে, কোনও সরকারের তা দূর করার শক্তি নেই।
ধর্মের অর্থ সমাজহিতকর বিধি, ধর্মপালনের অর্থ সামাজিক কর্তব্যপালন। এই ধর্মবোধ লুপ্ত হওয়ায় সমাজ ব্যাধিগ্রস্ত হয়েছে, অসংখ্য বীভৎস লক্ষণ সমাজদেহে ফুটে উঠেছে। ধনপতির তোষণ, দরিদ্রের শোষণ, কালোবাজারের প্রসার, সরকারী অর্থের অপব্যয়, উচ্চস্তরের কলঙ্ক চেপে রাখা, ইত্যাদি বড় বড় অপকীর্তির কথা অনেক পত্রিকায় থাকে, লোকের মুখে মুখেও রটনা হয়। কিন্তু যে সব অনাচার জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়েছে তার দিকে বিশেষ মন দেওয়া হয় না। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। অনেকে সজ্ঞানে এবং আরও অনেকে ভেড়ার পালের মতন অজ্ঞানে দুষ্ট লোককে ভোট দেয়। যে লোক দুষ্কর্ম করে ধনী হয়েছে তার সঙ্গে কুটুম্বিতা করবার জন্য সাধু লোকেও লালায়িত। অমুক অমুক দুষ্কর্ম করে বড়লোক হয়েছে, তুমিই বা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির হয়ে থাকবে কেন–এই রকম প্ররোচনা অনেক গৃহস্থ তার। পরিবারবর্গের নিকট পেয়ে থাকেন। ঘুষ দেওয়া আর নেওয়া চিরকালই ছিল কিন্তু এখন সহস্রগুণ বেড়ে গেছে। ছাত্রেরা না পড়েই পাস করতে এবং গায়ের জোরে ডিটেটর হতে চায়। সরস্বতী পূজা আর দোলের সময় যে কদর্য উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা যায় তাতে মনে হয় আমরা বন্য জাতির সগোত্র। শহরের অনেক রাস্তা নৈশ পায়খানায় পরিণত হয়েছে। বাড়ির উপরতলা থেকে কাগজে মোড়া ময়লা অকস্মাৎ পথচারীর গায়ে এসে পড়ে। বোম্বাই আর মাদ্রাজের সঙ্গে কলকাতার রাস্তা বাজার খাবারের দোকান ইত্যাদি মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় আমাদের পৌর নিগম কত অক্ষম, শহরবাসীর পরিচ্ছন্নতা বোধ কত অল্প। যে সব খ্যাতনামা পুরুষের মূর্তি দেশবাসী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিজ্ঞাপনের কাগজ এঁটে তার অপমান করা হয়, আমরা তাতে দৃপাত করি না; অবশেষে যখন স্টেটসম্যান কাগজে এই অনাচারের খবর ছাপা হয় তখন আমাদের হুঁশ হয়। ভদ্র গৃহস্থ ঔষধ আর প্রসাধন দ্রব্যের আধার অতি সাবধানে লেবেল নষ্ট না করে তুলে রাখে এবং জালিয়াতের প্রতিনিধি ফেরিওয়ালার কাছে তা বেশী দামে বেচে। জাল ভেজাল আর নকল দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। গুরুতর অপকীর্তির তুলনায় উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলি হয়তো তুচ্ছ, কিন্তু এইসব সামান্য লক্ষণ থেকেই বোঝা যায় যে সমাজের আপাদমস্তক ব্যাধিত হয়েছে।