বিজ্ঞান আর দর্শনের মাঝে একটি প্রান্তভূমি আছে, পণ্ডিতরা বহু দিন থেকে সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। এই গহন প্রদেশে এখনও ইচ্ছামত পরীক্ষা বা নিরীক্ষা চলে না, তাই তত্ত্বান্বেষীকে প্রধানত অনুমান আর কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। যাঁরা কঠোর যুক্তিবাদী তারা অতি সতর্ক হয়ে যথাসাধ্য অপক্ষপাতে রহস্য ভেদের চেষ্টা করছেন। বলা বাহুল্য, এই অনুসন্ধানে এখনও বেশী মতৈক্যের আশা নেই এবং কল্পনার বিলাস অবাধে চলছে। তারই নমুনাস্বরূপ কিঞ্চিৎ আলোচনা করছি।
.
বিদ্যাসাগর বোধাদয়ে লিখেছেন (ভাষাটি ঠিক মনে নেই)–আমরা ইতস্তত যে সমুদায় বস্তু দেখিতে পাই তাহাদিগকে পদার্থ কহে। আর একটু বিশদ করে বলা যেতে পারে–আমরা যেসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পৃথক পৃথক বিষয়ের সংস্রবে আসি তাদের নাম পদার্থ। মানুষ জন্তু গাছ নক্ষত্র পাহাড় নদী বাড়ি ইট শস্যকণা জীবাণু সবই পদার্থ। পদার্থের উৎপত্তি স্থিতি ও বিনাশ হতে পারে, কিন্তু অনেক পদার্থের উৎপত্তি-বিনাশ দেখবার সুযোগ আমাদের নেই, যেমন নক্ষত্র, হিমালয় পর্বত। পদার্থ মাত্রই নিরন্তর বদলাচ্ছে, আজ যেমন আছে কাল তেমন থাকবে না, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন অত্যন্ত মন্থর, সেজন্য আমাদের অগোচর।
একটি দার্শনিক সংজ্ঞা আছে–একদেশসম্বন্ধ। আমি যখন কোনও গাড়িতে চড়ি বা বিছানায় শুই তখন আমার সর্ব দেহ দিয়ে গাড়ি বা বিছানার সমস্তটা ব্যাপ্ত করে থাকি না, এক অংশেই থাকি, তাই তার সঙ্গে আমার একদেশসম্বন্ধ হয়। মায়ের সঙ্গে কোলের ছেলের, আমার সঙ্গে আমার হাতে ধরা কলমের এই সম্বন্ধ। এই সম্বন্ধ অল্পকালস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, একবার ঘুচে গিয়ে আবার স্থাপিত হতে পারে, চিরকালের জন্য লুপ্তও হতে পারে। একদেশসম্বন্ধের ন্যায় এককালসম্বন্ধও আমরা কল্পনা করতে পারি। আমার পিতা এখন মৃত। তিনি আর আমি কয়েক বৎসর একই কালে বিদ্যমান ছিলাম, তখন তাঁর সঙ্গে আমার এককালসম্বন্ধ ছিল। দুজন লোক যদি একই মুহূর্তে জন্মায় এবং এক সঙ্গেই মরে তবে বলা যেতে পারে যে তাদের সমকালসম্বন্ধ আছে, কিন্তু এমন সম্বন্ধ দুর্ঘট। কোনও সময়ে জগতে যত লোক জীবিত থাকে তাদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় বা সাক্ষাৎকার না হলেও এককালসম্বন্ধ হয়। এই সম্বন্ধ মৃত্যুতে ছিন্ন হয়, একদেশসম্বন্ধের ন্যায় পুনর্বার স্থাপিত হতে পারে না। জীবন-মৃত্যু মিলন-বিরহ আমাদের পক্ষে চিত্তবিক্ষোভকর গুরুতর ব্যাপার, কিন্তু উদাসীন তত্ত্বদর্শী বলেন–
যথা কাষ্ঠঞ্চ কাষ্ঠঞ্চ সমেয়াতাং মহোদধৌ।
সমেত্য চ ব্যপেয়াং তদ্ভূতসমাগমঃ ॥
(মহাভারত, শান্তিপর্ব)
–মহাসমুদ্রে ভাসতে ভাসতে এক খণ্ড কাষ্ঠ অপর এক কাষ্ঠের সঙ্গে মিলিত হয়, আবার দূরে চলে যায়; প্রাণিগণের মিলন-বিরহও সেইরূপ।
আমরা কি শুধুই কাষ্ঠং কাষ্ঠং? মৃত্যুর পরে কি পুনর্বার মিলনের সম্ভাবনা নেই? হিন্দু খ্রীষ্টান মুসলমান এক বাক্যে বলেন, অবশ্যই আছে, আত্মা মরে না, পরজন্মে অথবা স্বর্গে বা নরকে আবার মিলন হতে পারবে। এই ধারণায় মন তৃপ্ত হতে পারে, কিন্তু যুক্তিবাদী তত্ত্বান্বেষী এমন শূন্যগর্ভ আশ্বাসে ভোলেন না। তিনি বলেন, ইহকালে আমাদের অস্তিত্ব কি রকম তাই আগে জানা দরকার, পরকালের কথা পরে ভাবব। শাস্ত্রে আছে–আত্মানং বিদ্ধি, আত্মাকে জান। আত্মা বললে ঠিক কি বোঝায় তা জানি না; তার বদলে আমার প্রত্যক্ষ স্থূল সত্তাকে বোঝবার চেষ্টা করব।
.
বোধোদয়ের মতে আমি একটি চেতন পদার্থ, ধরাধামে আমার অস্তিত্ব জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। বাল্যকালে আমি যেরকম ছিলাম এখন সেরকম নেই, শরীর আর মতিগতি অনেক বদলেছে। এই পরিবর্তমান আমি কি একই পদার্থ? বহু লোকে বলেন, দেহের আর মনের যতই অদলবদল হক তোমার আত্মা বরাবর একই আছে, পরলোকেও থাকবে। যাঁরা বলেন তারা কেউ পরলোক-ফেরত নন, সুতরাং তাঁদের কথার মূল্য নেই। গীতায় আছে, জীব আদিতে ও মরণান্তে অব্যক্ত, মধ্যে ব্যক্ত; অর্থাৎ জন্মের আগে এবং মৃত্যুর, পরে জীবের অবস্থা অজ্ঞাত, কেবল জীবিতাবস্থাই জ্ঞাত। অতএব এই প্রত্যক্ষ জীবিতাবস্থারই বিচার করে দেখা যাক আমার সত্তা কিরকম। আমার ছেলেবেলার ছবির সঙ্গে বুড়ো বয়সের ছবির অল্প মিল থাকতে পারে, কিন্তু দুটি বিভিন্ন ক্ষণিক বিষয়ের প্রতিরূপ। আমার স্বভাব শক্তি রুচি বিদ্যাবুদ্ধিরও এইরকম পরিবর্তন হয়েছে। বস্তুত আমি একটি পদার্থ নই, অসংখ্য পদার্থের পরম্পরা, যেমন সিনেমার ছবি। মনে করুন হীরাবাই-নাটকের সিনেমা-ফিল্ম দশ হাজার ফুট লম্বা। তার সমস্ত রীলকে বলা যেতে পারে হীরাবাই ফিল্ম, কিন্তু এক টুকরোকে এ নাম দেওয়া যায় না। ফিল্মের রীল যখন কৌটায় থাকে তখন খানিকটা জায়গা জুড়ে থাকে, অর্থাৎ তার দু-চার ঘনফুট দেশব্যাপ্তি আছে। কিন্তু তার ছবি যখন পর্দায় দেখানো হয় তখন তার প্রায় ২০০ বর্গফুট দেশব্যাপ্তি হয় এবং সেই সঙ্গে প্রায় দু ঘণ্টা কালব্যাপ্তি হয়। দেশে কালে ব্যাপ্ত এই চিত্র পরম্পরাই হীরাবাই-নাটকের যথার্থ প্রতিরূপ; ফিল্মের রীল সেই প্রতিরূপের উৎপাদক মাত্র।
অতএব আমার যথার্থ সত্তা আমার সমগ্র জীবন। শুধু দেশে কালে ব্যাপ্ত আমার শরীর নয়, আমার চিত্ত ও কর্মও এই সত্তার অঙ্গীভূত। যদি সত্তর বৎসর বাঁচি তবে এই সময়ের মধ্যে আমার শারীরিক মানসিক যত পরিবর্তন হয়েছে, আমি সুখ দুঃখ অনুরাগ বিরাগ যা ভোগ করেছি, সুকর্ম দুষ্কর্ম যা করেছি, সব সুদ্ধ নিয়ে আমার সত্তা। আমাকে পদার্থ বললে ছোট করা হবে, আমি সত্তর বৎসর ব্যাপী একটি ঘটনাপ্রবাহ। এ ভিন্ন যদি আমার অন্যবিধ সত্তা মানা হয় তবে তা ক্ষণিক, অসম্পূর্ণ, অথবা অপ্রমাণিত।