যেখানে কোনও লোকের স্বমহিমা পর্যাপ্ত মনে হয় না সেখানেই আড়ম্বর আসে। দরোয়ানের চৌগোঁপা পাগড়ি আর জমকালো পোশাক, ফিল্ড মার্শালের ভালুকের চামড়ার প্রকাণ্ড টুপি, সন্ন্যাসী বাবাজীর দাড়ি জটা গেরুয়া আর সাতনরী রুদ্রাক্ষের মালা–এ সমস্তই মহিমা বাড়াবার কৃত্রিম উপায়। আধুনিক শংকরাচার্যদের নামের পূর্বে এক শ আট শ্ৰী না দিলে তাদের মান থাকে না, কিন্তু আদি শংকরাচার্যের শ্রীর প্রয়োজন নেই, এবং হরি দুর্গা কালী প্রভৃতি দেবতা দু-একটি শ্ৰীতেই তুষ্ট।
বাণ গৌড়ী রীতির লক্ষণ বলেছেন, অক্ষরডম্বর। এই আড়ম্বরের প্রবৃত্তি এখনও আছে। অনেক বাক্যে অকারণে শব্দবাহুল্য এসে পড়েছে, লেখকরা গতানুগতিক ভাবে এই সব সাড়ম্বর বাক্য প্রয়োগ করেন। সন্দেহ নাই এই সরল প্রয়োগ প্রায় উঠে গেছে, তার বদলে চলছে–সন্দেহের অবকাশ নাই। চা পান বা চা খাওয়া চলে না, চা পর্ব লেখা হয়। মিষ্টান্ন খাইলাম স্থানে মিষ্টান্নের সদ্ব্যবহার করা গেল। মাঝে মাঝে অলংকার হিসাবে এরকম প্রয়োগ সার্থক হতে পারে, কিন্তু যদি বার বার দেখা যায় তবে তা মুদ্রাদোষ।
শব্দের অপচয় করলে ভাষা সমৃদ্ধ হয় না, দুর্বল হয়। যেখানে ব্যর্থ হইবে লিখলে চলে সেখানে দেখা যায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইবে। অনেকে দিলেন স্থানে প্রদান করিলেন, যোগ দিলেন স্থানে অংশগ্রহণ করিলেন বা যোগদান করিলেন, গেলেন স্থানে গমন করিলেন লেখেন। হিন্দীভাষী লিখলেই অর্থ প্রকাশ পায়, অথচ লেখা হয় হিন্দীভাষাভাষী, কাজের জন্য (বা কর্মসূত্রে) বিদেশে গিয়াছেন–এই সরল বাক্যের স্থানে দুরূহ অশুদ্ধ প্রয়োগ দেখা যায়–কর্মব্যপদেশে বিদেশে গিয়াছেন। ব্যপদেশের মানে ছল বা ছুতা। পূর্বেই ভাবা উচিত ছিল স্থানে লেখা হয়–পূর্বাহেই…। পূর্বাহের একমাত্র অর্থ–সকালবেলা।
বাংলা একটা স্বাধীন ভাষা, তার নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্তি আছে, সংস্কৃতের বশে চলবার কোনও দরকার নেই–এই কথা অনেকে বলে থাকেন। অথচ তাদের মধ্যেও প্রচ্ছন্ন বিকৃত সংস্কৃতপ্রীতি দেখা যায়। বাংলা চলন্ত শব্দ আছে, তবু তারা সংস্কৃত মনে করে অশুদ্ধ চলমান লেখেন, বাংলা আগুয়ান স্থানে অশুদ্ধ অগ্রসরমান লেখেন, সুপ্রচলিত পাহারা স্থানে প্রহরা লেখেন। বাকীর সংস্কৃত বক্ৰী নয়, পাঁঠার সংস্কৃত পন্টক নয়, পাহারার সংস্কৃতও প্রহরা নয়।
অনেক লেখকের শব্দবিশেষের উপর ঝোঁক দেখা যায়, তারা তাদের প্রিয় শব্দ বার বার প্রয়োগ করেন। একজন গল্পকারের লেখায় চার পৃষ্ঠায় পঁচিশ বার রীতিমত দেখেছি। অনেকে বার বার বৈকি লিখতে ভালবাসেন। কেউ কেউ অনেক প্যারাগ্রাফের আরম্ভে হ বসান। আধুনিক লেখকরা যুবক যুবতী বর্জন করেছেন, তরুণ তরুণী লেখেন। বোধ হয় এঁরা মনে করেন এতে বয়স কম দেখায় এবং লালিত্য বাড়ে। অনেকে দাঁড়ির বদলে অকারণে বিস্ময়চিহ্ন (!) দেন। অনেকে দেদার বিন্দু (…) দিয়ে লেখা ফাঁপিয়ে তোলেন। অনাবশ্যক হচিহ্ন দিয়ে লেখা কণ্টকিত করা বহু লেখকের মুদ্রাদোষ। ভেজিটেবল ঘিএর বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যে খাবার তৈরির বিধি দেওয়া থাকে তাতে দেখেছি–তিটি ডিম্ ভেঙ্গে নি, তাতে একটু নুন্ দিন্।
.
আর একটি বিজাতীয় মোহ আমাদের ভাষাকে আচ্ছন্ন করেছে। একে মুদ্রাদোষ বললে ছোট করা হবে, বিকার বলাই ঠিক। ব্রিটিশ শাসন গেছে, কিন্তু ব্রিটিশ কর্তার ভূত আমাদের আচার-ব্যবহারে আর ভাষায় অধিষ্ঠান করে আছে। বিদেশীর কাছ থেকে আমরা বিস্তর ভাল জিনিস পেয়েছি। দু শ বৎসরের সংসর্গের ফলে আমাদের কথায় ও লেখায় কিছু কিছু ইংরেজী রীতি আসবে তা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু কি বর্জনীয়, কি উপেক্ষণীয় এবং কি রক্ষণীয় তা ভাববার সময় এসেছে।
পাঁচ বছরের মেয়েকে নাম জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয় কুমারী দীপ্তি চ্যাটার্জি। সুশিক্ষিত লোকেও অম্লানবদনে বলে–মিস্টার বাসু (বা বাসিউ), মিসেস রয়, মিস ডাট। মেয়েদের নামে ডলি লিলি রুবি ইভা প্রভৃতির বাহুল্য দেখা যায়। যার নাম শৈল বা শীলা সে ইংরেজীতে লেখে Sheila৷ অনিল হয়ে যায় Oneil, বরেন হয় Warren। এরা স্বনামের ধন্য হতে চায় না, নাম বিকৃত করে ইংরেজের নকল করে। এই নকল যে কতটা হাস্যকর ও হীনতাসূচক তা খেয়াল হয় না। সংক্ষেপের জন্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যানার্জি না করে বন্দ্যো করলে দোষ কি? সেই রকম মুখো চট্ট গঙ্গো ভট্টও চলতে পারে। সম্প্রতি অনেকে নামের মধ্যপদ লোপ করেছেন, নাথ চন্দ্র কুমার মোহন ইত্যাদি বাদ দিয়েছেন। ভালই করেছেন। দিব্যেন্দ্রনারায়ণ প্রভৃতি প্রকাণ্ড নাম এখন ফ্যাশন নয়। পদবীও সংক্ষিপ্ত করলে ক্ষতি কি? মিস-এর অনুকরণে কুমারী লিখলে কি লাভ হয়? কয়েক বৎসর পূর্বেও কুমারী সধবা বিধবা সকলেই শ্ৰীমতী ছিলেন। এখন কুমারীকে বিশেষ করার কি দরকার– হয়েছে? পুরুষের কৌমার্য তো ঘোষণা করা হয় না।
প্রতিষ্ঠাতাকে স্মরণ করে কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজের নাম আর জি কর কলেজ করা হয়েছে। ইংরেজি অক্ষর না দিয়ে রাধাগোবিন্দ কলেজ করলেই কালোচিত হত। একটি সমিতির বিজ্ঞাপন মাঝে মাঝে দেখতে পাই–Better Bengal Society। বাংলা দেশ এবং বাঙালীর উন্নতি করাই যদি উদ্দেশ্য হয় তবে ইংরেজী নাম আর ইংরেজী বিজ্ঞাপন কেন? এখনও কি ইংরেজ মুরব্বীর প্রশংসা পাবার আশা আছে?