ভারতীয় হিন্দুর পৃথক পিতৃভূমি নেই, অর্থাৎ ভারতের বাইরে এমন কোনও দেশ নেই যেখানে হিন্দুধর্ম প্রথমে উদ্ভূত হয়েছিল এবং যেখানে এখনও হিন্দু আছে। বৈদিক আর্যগণের আদিভূমি উত্তর মেরুর কাছে বা চীন তুর্কিস্থানে বা উত্তর-পারস্যে হতে পারে, কিন্তু এখন সেখানে হিন্দু নেই। মুসলমানের যেমন আরব ইরান তুর্কি আছে হিন্দুর সেরকম কিছু নেই, তার ফলে হিন্দুর সাজাত্যবোধ এবং সমস্ত ঐতিহ্য ভারতেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। হিন্দুর ধর্ম ভারতেই উৎপন্ন হয়েছে, তার উপাদান শুধু বেদ আর তন্ত্র নয়, বৌদ্ধ জৈন মুসলমান খ্রীষ্টান এবং বহু আদিম জাতির ধর্মও তাকে প্রভাবিত করেছে। হিন্দুর রক্ত, সংস্কার, ধর্ম কিছুই অবিমিশ্র নয়। ভারতে উদ্ভূত অতি জটিল হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে গত দেড় শ বৎসরে ইওরোপীয় সংস্কৃতিরও যোগ হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও হবে।
স্বধর্মনিষ্ঠার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে স্বধর্মচ্যুতির অকারণ আশঙ্কা জড়িত থাকে। গোঁড়া হিন্দু ভক্ষ্য-অভক্ষ্য, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য, কৃত্য-অকৃত্য, কাল-অকাল প্রভৃতি বিচার করে সাবধানে জীবনযাপন করে। মিথ্যা কথা, প্রতারণা বা পরস্পাপহরণে ধর্মচ্যুতি হয় না, কিন্তু গ্রহণের সময় খেলে বা বিধবাকে গহনা পরতে দিলে হয়। সাধুতার চেয়ে লোকাঁচার বড় এই ধারণা সকল ধর্মের গোঁড়া লোকের মধ্যে আছে। যারা স্মরণীয় কালের মধ্যে ধর্মান্তর নিয়েছে অথবা সমাজের এক স্তর থেকে উচ্চতর স্তরে উঠেছে তাদের মধ্যে পূর্বধর্মের ছোঁয়াচ লাগবার প্রবল আশঙ্কা দেখা যায়। পৌত্তলিকতা প্রতিরোধের জন্য মুসলমান ধর্মে যত কঠিন বিধি আছে খ্রীষ্টধর্মের কোনও শাখায় ততটা দেখা যায় না। এই সব বিধিনিষেধের আদি কারণ মুসলমান সমাজবিজ্ঞানীরা বলতে পারেন। এর মূলে এই আশঙ্কা থাকতে পারে যে পূর্বপুরুষদের উৎসববহুল সরস ধর্মের প্রতি লোকের একটা প্রচ্ছন্ন আকর্ষণ আছে, একটু অসতর্ক হলেই পতন হবে। হিন্দুর অনেক নিয়মের মূলেও হয়তো এই ধারণা আছে যে লঙ্ঘন করলেই অনার্যতার মোহময় পঙ্কে পড়তে হবে। শিক্ষিত বাঙালী, খ্রীষ্টানদের মধ্যেই এই শুচিবাতিক দেখা যেত, কিন্তু এখন বোধ হয় কমে গেছে। এককালে ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের উপর অনেক সামাজিক নির্যাতন হয়েছে। দেশী খ্রীষ্টানদের উপর তেমন কিছু হয় নি, কারণ তারা সাহেব পাদরীর আশ্রিত। অসহায় ব্রাহ্মরা আত্মরক্ষার জন্য গোঁড়া হিন্দুদের সংশ্রব যথাসম্ভব পরিহার করতেন এবং স্বধর্মচ্যুতির ভয়ে পৌত্তলিকতার সকল চিহ্ন এড়িয়ে চলতেন। সুখের বিষয়, শিক্ষিত হিন্দুর গোঁড়ামি আর অনুদারতা আজকাল অনেক কমে গেছে, ব্রাহ্মদেরও স্বতন্ত্রভাব এবং ধর্মচ্যুতির আতঙ্ক পূর্বের মতন নেই।
.
রবীন্দ্রনাথ সমাজ পুস্তকে আত্মপরিচয় নামক প্রবন্ধে হিন্দুত্বের এই অর্থ দিয়েছেন—
হিন্দু সমাজে যে সম্প্রদায় কিছুদিন ধরিয়া যে ধর্ম এবং যে আচারকেই হিন্দু বলিয়া মানিয়া আসিয়াছে তাহাই তাহার পক্ষে হিন্দুত্ব এবং তাহার ব্যতিক্রম তাহার পক্ষেই হিন্দুত্বের ব্যতিক্রম।
রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন–
আমি হিন্দুসমাজে জন্মিয়াছি এবং ব্রাহ্ম সম্প্রদায়কে গ্রহণ করিয়াছি– ইচ্ছা করিলে আমি অন্য সম্প্রদায়ে যাইতে পারি, কিন্তু অন্য সমাজে যাইব কি করিয়া। সে সমাজের ইতিহাস তো আমার নয়। গাছের ফল এক ঝাঁকা হইতে অন্য ঝাঁকায় যাইতে পারে, কিন্তু এক শাখা হইতে অন্য শাখায় ফলিবে কি করিয়া। তবে কি মুসলমান বা খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ে যোগ দিলেও তুমি হিন্দু থাকিতে পারো? নিশ্চয়ই পারি… বাংলা দেশে হাজার হাজার মুসলমান আছে, হিন্দুরা অহর্নিশি তাহাদিগকে হিন্দু নও হিন্দু নও বলিয়াছে এবং তাহারাও নিজদিগকে হিন্দু নই হিন্দু নই শুনাইয়া আসিয়াছে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাহারা প্রকৃতই হিন্দু-মুসলমান। কোনো হিন্দু পরিবারে এক ভাই খ্রীষ্টান, আর এক ভাই মুসলমান, ও এক ভাই বৈষ্ণব এক পিতামাতার স্নেহে একত্রে বাস করিতেছে এই কথা কল্পনা করা কখনই দুঃসাধ্য নহে…কারণ ইহাই যথার্থ সত্য, সুতরাং মঙ্গল ও সুন্দর।… মুসলমান একটি বিশেষ ধর্ম, কিন্তু হিন্দু কোনও বিশেষ ধর্ম নহে।
রবীন্দ্রনাথ যে ব্যাপক অর্থে হিন্দু শব্দ প্রয়োগ করেছেন সে অর্থ এখন চলবার কোনও সম্ভাবনা নেই। হিন্দু শব্দের আধুনিক অর্থ দাঁড়িয়েছে– ভারতজাত-ধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধ জৈন শিখ ব্রাহ্ম সনাতনী–এরা হিন্দু, কিন্তু মুসলমান খ্রীষ্টান হিন্দু নয়। যদি এই সংকীর্ণ সংজ্ঞার্থের প্রচলন নাও হত তথাপি কোনও মুসলমান হিন্দু নামের অন্তর্ভুক্ত হতে চাইত না। রবীন্দ্রনাথ যে সাজাত্যবোধ কামনা করেছিলেন তা এখন ভারতীয় নামের উপর গড়ে উঠতে পারে।
পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতদের মতে nationality বা সাজাত্যের কারণ–নিবাস, উৎপত্তি (origin), ভাষা, ধর্ম, ঐতিহ্য (tradition), সংস্কৃতি ও স্বার্থের ঐক্য। কোনও রাষ্ট্রে এই ঐক্য পুরোপুরি না থাকলেও সাজাত্যের প্রতিষ্ঠা হতে পারে। মার্কিন রাষ্ট্রে উৎপত্তি আর ঐতিহ্যের ঐক্য নেই, ধর্মও সমান নয় (প্রোটেস্টান্ট, ক্যাথলিক, ইহুদী), ভাষার ঐক্য প্রয়োজনের বশে হয়েছে। কানাডারও ওই অবস্থা, সেখানে ভাষারও ঐক্য নেই। সুইটজারলান্ডেও উৎপত্তি ভাষা আর ধর্ম সমান নয়। সোভিএট রাষ্ট্রে নিবাস আর স্বার্থ ছাড়া আর কিছুর ঐক্য নেই, ধর্ম সেখানে দুর্বল সেজন্য গণ্য নয়। তথাপি এই সব রাষ্ট্রের অধিবাসীরা সাজাত্য লাভ করেছে। সমগ্র ভারতরাষ্ট্রে উৎপত্তি আর ভাষার যতই ভেদ থাকুক, প্রদেশের (রাজ্যের বা স্টেটের মধ্যে ভেদ সর্বত্র নেই, পশ্চিমবঙ্গে মোটেই নেই, স্বার্থও সকলের সমান।