বিজ্ঞানী এবং সর্ব শ্রেণীর বিশেষজ্ঞের উপর জনসাধারণের প্রচুর আস্থা দেখা যায়। অনেকে মনে করে, অধ্যাপক ডাক্তার উকিল এঞ্জিনিয়ার প্রভৃতি নিজ নিজ বিষয়ে সর্বজ্ঞ। কোনও প্রশ্নের উত্তরে যদি বিশেষজ্ঞ জানি না বলেন তবে প্রশ্নকারী ক্ষুণ্ণ হয়, কেউ কেউ স্থির করে এঁর বিদ্যা বিশেষ কিছু নেই। সাধারণে যেসব বিষয়ের জন্য বিশেষজ্ঞকে প্রশ্ন করে তার অধিকাংশ স্বাস্থ্যবিষয়ক, কিন্তু জ্যোতিষ পদার্থবিদ্যা রসায়ন জীববিদ্যা প্রভৃতি সম্বন্ধেও অনেকের কৌতূহল দেখা যায়।
তুচ্ছ অতুচ্ছ সরল বা দুরূহ যেসকল বিষয় সাধারণ জানতে চায় তার কয়েকটি নমুনা দিচ্ছি। ধূমপানে দাঁতের গোড়া শক্ত হয় কি না? পাতি বা কাগজি লেবু কোন্টায় ভাইটামিন বেশী? মিছরির ফুড-ভ্যালু কি চিনির চাইতে বেশী? রবারের জুতো পরলে কি চোখ খারাপ হয়? নূতন সিমেন্টের মেঝে ঘামে কেন? উদয়-অস্তের সময় চন্দ্র সূর্য বড় দেখায় কেন? সাপ নাকি শুনতে পায় না? কেঁচো আর পিঁপড়ের বুদ্ধি আছে কি না? দাবা খেললে আর অঙ্ক কষলে বুদ্ধি বাড়ে কি না? বাসন মাজার কাঁচ কাঁচ শব্দে গা শিউরে ওঠে কেন?
যে প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক সমাধান এখনও হয় নি তার উত্তর দেওয়া অবশ্য অসম্ভব। অনেক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভবপর হলেও তা অল্পশিক্ষিত লোককে বোঝানো যায় না, সরল প্রশ্নের উত্তরও অতি দুর্বোধ হতে পারে। যাঁকে প্রশ্ন করা হয় তিনি সবগুলির উত্তর নাও জানতে পারেন। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই প্রশ্নকারীকে যা তা বলে ভোলানো উচিত নয়। যদি উপযুক্ত উত্তর দেওয়ায় বাধা থাকে তবে সরলভাবে বলা উচিত, তোমার প্রশ্নের উত্তর এখনও নির্ণীত হয় নি, অথবা প্রশ্নটির উত্তর বোঝানো কঠিন, অথবা উত্তর আমার জানা নেই। দুঃখের বিষয়, অনেকে মনে করেন, যা হয় একটা উত্তর না দিলে মান থাকবে না। উত্তরদাতার এই দুর্বলতা বা সত্যনিষ্ঠার অভাবের ফলে জিজ্ঞাসুর মনে অনেক সময় ভ্রান্ত ধারণা উৎপন্ন হয়। আমেরিকান লেখক William Beebe তার Jungle Peace নামক গ্রন্থে একটি অমূল্য উপদেশ দিয়েছেন–These words should be ready for instant use by every honest scientist, I dont know.
প্রত্যেক বিষয়ে মত স্থির করবার আগে যদি তন্ন তন্ন বিচার করতে হয় তবে জীবনযাত্রা দুর্বহ হয়ে পড়ে। সর্বক্ষণ সতর্ক ও যুক্তি-পরায়ণ হয়ে থাকা সহজ নয়। বিজ্ঞানী অবিজ্ঞানী সকলেই নিত্য নৈমিত্তিক সাংসারিক কার্যে অনেক সময় অপ্রমাণিত সংস্কারের বশে বা চিরাচরিত অভ্যাস অনুসারে চলেন। এতে বিশেষ দোষ হয় না যদি তারা উপযুক্ত প্রমাণ পেলেই সংস্কার ও অভ্যাস বদলাতে প্রস্তুত থাকেন।
তীক্ষ্ণবুদ্ধি বিজ্ঞানী যখন তাঁর গবেষণাক্ষেত্রের বাইরে আসেন তখন তিনিও সাধারণ লোকের মতন অসাবধান হয়ে পড়েন। বিজ্ঞানী অবিজ্ঞানী সকলেই অনেক সময় কুযুক্তি বা হেত্বাভাস আশ্রয় করেন। আবার সময়ে সময়ে অশিক্ষিত লোকেরও স্বভাবলব্ধ বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি দেখা যায় এবং চেষ্টা করলে অনেকেই তা আয়ত্ত করতে পারেন। অল্পদর্শিতা, অসতর্কতা ও অন্ধ সংস্কারের ফলে সাধারণ লোকের বিচারে যেরকম ভুল হয় তার কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।–
যদুবাবু সুশিক্ষিত লোক। তিনি ব্ল্যাক আর্ট নামক ম্যাজিক দেখে এসে বললেন, কি আশ্চর্য কাণ্ড! জাদুকর শূন্য থেকে ফুলদানি টেবিল চেয়ার খরগোশ বার করছে, নিজের মুণ্ড উপড়ে ফেলে দু হাত দিয়ে লুফছে, একটা নরকঙ্কালের সঙ্গে নাচতে নাচতে পলকের মধ্যে সেটাকে সুন্দরী নারীতে রূপান্তরিত করছে। শত শত লোক স্বচক্ষে দেখেছে। এর চেয়ে প্রত্যক্ষ প্রমাণ আর কি হতে পারে? অলৌকিক শক্তি ভিন্ন এমন ব্যাপার অসম্ভব। যদুবাবু এবং অন্যান্য দর্শকরা প্রত্যক্ষ করেছেন বটে, কিন্তু সমস্ত প্রত্যক্ষ করতে পারেন নি। রঙ্গমঞ্চের ভিতরটা আগাগোড়া কালো কাপড়ে মোড়া। ভিতরে আলো নেই, কিন্তু মঞ্চের ঠিক বাইরে চারি ধারে উজ্জ্বল আলো, তাতে দর্শকের চোখে ধাঁধা লাগে। ভিতরের কোন বস্তু বা মানুষ কাল কাপড়ে ঢাকা থাকলে অদৃশ্য হয়, ঢাকা খুললেই দৃশ্য হয়। জাদুকর কাল ঘোমটা পরলে তাঁর মুণ্ড অন্তর্হিত হয়, তখন তিনি একটা কৃত্রিম মুণ্ড নিয়ে লোফালুফি করেন। তার সঙ্গিনী কাল বোরখা পরে নাচে, বোরখার উপর সাদা কঙ্কাল আঁকা থাকে। বোরখা ফেলে দিলেই রূপান্তর ঘটে।
মহাপুরুষদের অলৌকিক ক্রিয়ার কথা অনেক শোনা যায়। বিশ্বাসী ভক্তরা বলেন, অমুক বাবার দৈবশক্তি মানতেই হবে, শূন্য থেকে নানারকম গন্ধ সৃষ্টি করতে পারেন। আমার কথা না মানতে পার, কিন্তু বড় বড় প্রফেসররা পর্যন্ত দেখে অবাক হয়ে গেছেন, তাদের সাক্ষ্য তো অবিশ্বাস করতে পার না’। এইরকম সিদ্ধান্ত যারা করেন তারা বোঝেন না যে প্রফেসর বা উকিল জজ পুলিস অফিসার ইত্যাদি নিজের ক্ষেত্রে তীক্ষ্ণবুদ্ধি হতে পারেন, কিন্তু অলৌকিক রহস্যের ভেদ তাদের কর্ম নয়। জড় পদার্থ ঠকায় না, সেজন্য বিজ্ঞানী তার পরীক্ষাগারে যা প্রত্যক্ষ করেন তা বিশ্বাস করতে পারেন। কিন্তু যদি ঠকাবার সম্ভাবনা থাকে তবে চোখে ধূলো দেওয়া বিদ্যায় যাঁরা বিশারদ (যেমন জাদুকর), কেবল তাদের সাক্ষ্যই গ্রাহ্য হতে পারে। রামায়ণে সীতা বলেছেন, অহিরেব অহেঃ পাদান্ বিজানাতি ন সংশয়ঃসাপের পা সাপেই চিনতে পারে তাতে সংশয় নেই। কিন্তু বিচক্ষণ ওস্তাদের পক্ষেও বাবা স্বামী ঠাকুর প্রভৃতিকে পরীক্ষা করা সাধ্য নয়, কারণ তাদের কাপড়-চোপড় বা শরীর তল্লাশ করতে চাইলে ভক্তরা মারতে আসবেন। বৈজ্ঞানিক বিচারের একটি নিয়ম কোনও ব্যাপারের ব্যাখ্যা যদি সরল বা পরিচিত উপায়ে সম্ভবপর হয় তবে জটিল বা অজ্ঞাত বা অলৌকিক কারণ কল্পনা করা অন্যায়।