প্রাচীন ভারতের চতুর্বর্গ বা পুরুষার্থ ছিল–ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ। সংসারী মানুষের পক্ষে এই চারটি বিষয়ের সাধনা শ্রেয়স্কর বিবেচিত হত। বর্তমান কালে বিজ্ঞান পঞ্চম পুরুষার্থ তাতে সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানের অবহেলার ফলে ভারতবাসী দীর্ঘকাল দুর্গতি ভোগ করেছে, এখন তাকে সযত্নে সাধনা করতে হবে। কিন্তু মনে রাখা আবশ্যক–কোনও নবাবিষ্কৃত বস্তুর প্রয়োগের পরিণাম দূর ভবিষ্যতে কি রকম দাঁড়াবে তা সকল ক্ষেত্রে অনুমান করা অসম্ভব। ডাক্তার বেন্টলি বলে গেছেন, বাংলা দেশে ম্যালেরিয়ার বিস্তারের কারণ রেলপথের অসতর্ক বিন্যাস। পেনিসিলিনে বহু রোগের বীজ নষ্ট হয়, কিন্তু দেখা গেছে অসতর্ক প্রয়োগে এমন জীবাণুবংশের উদ্ভব হয় যা পেনিসিলিনে মরে না। ডিডিটি প্রভৃতি কীটঘের ক্রিয়া প্রতিরোধ করতে পারে এমন মশক-বংশও দেখা দিয়েছে। বিকিনিতে যে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা হয়েছিল তার ফলে বহুদূরস্থ জাপানী জেলেরা ব্যাধিগ্রস্ত হবে এ কথা মার্কিন বিজ্ঞানীরা ভাবতে পারেন নি। মোট কথা, বিজ্ঞানের সুপ্রয়োগে যেমন মঙ্গল হয় তেমনি নিরঙ্কুশ প্রয়োগে অনেক ক্ষেত্রে সুফলের পরিবর্তে অবাঞ্ছিত ফলও দেখা দিতে পারে।
বিলাতী খ্রীষ্টান ও ভারতীয় হিন্দু
ষাট-সত্তর বৎসর পূর্বে শিক্ষিত বাঙালী হিন্দুর বিতর্কের প্রধান বিষয় ছিল ধর্মমত। রামমোহন বঙ্কিমচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত অনেক মনীষী পাদরীদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধ করেছিলেন। তার পর রাজনীতির চাপে ধর্মের সমালোচনা ক্রমশ লুপ্ত হয়ে গেল। কিন্তু ফ্যাশন ও রুচি নিরন্তর বদলায়, কালক্রমে পুরনো বিষয়ও রুচিকর বা কৌতূহলজনক হতে পারে। এই বিশ্বাসে আধুনিক বিলাতী খ্রীষ্টীয় সমাজের সঙ্গে আধুনিক শিক্ষিত হিন্দুসমাজের কিঞ্চিৎ তুলনা করছি। হিন্দুর সম্বন্ধে যা লিখছি তা প্রধানত বাঙালীর উদ্দেশ্যে হলেও বহু অবাঙালী সম্বন্ধেও খাটে। সম্প্রতি হিন্দু শব্দের অর্থ প্রসারিত হয়েছে–ভারত-জাত-ধর্মাবলম্বী সকলেই হিন্দু। এই প্রবন্ধে কেবল সনাতনপন্থী হিন্দু অর্থে হিন্দু শব্দ প্রয়োগ করছি।
রিলিজন শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ নেই। হিন্দুধর্ম বললে যা বোঝায় তা ঠিক রিলিজন নয়, কিন্তু বৈষ্ণব বা ব্রাহ্ম ধর্মকে রিলিজন বলা চলে। ক্রীড অর্থাৎ নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা মূলমন্ত্র না থাকলে রিলিজন হয় না। খ্রীষ্টধর্মের ক্রীড আছে, যথা–ট্রিনিটি বা ঈশ্বরের ত্রিত্ব, যিশুর অলৌকিক জন্ম, মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য তাঁর ক্রুসারোহণ, মৃত্যুর পর তৃতীয় দিনে পুনরুত্থান ও স্বর্গারোহণ, মানুষের পরিত্রাণের নিমিত্ত যিশুশরণের আবশ্যকতা, ইত্যাদিতে বিশ্বাস। ব্রাহ্মধর্মেরও ক্ৰীড আছে। অনেকে মনে করেন হিন্দুরও আছে, যথা-বেদ, জাতিভেদ, পুনর্জন্ম ও মূর্তিপূজায় আস্থা, খাদ্যাখাদ্য বিচার, ইত্যাদি। কিন্তু এর একটিও হিন্দুত্বের সুনির্দিষ্ট বা অপরিহার্য লক্ষণ নয়। আমরা বেদবাক্য বলি, কিন্তু তা কেবল কথার কথা। সাধারণ হিন্দু বেদের কোনও খবরই রাখে না, সুতরাং বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন ওঠে না। আজকাল জাতিভেদ পুনর্জন্ম প্রভৃতি না মানলেও হিন্দুত্বের হানি হয় না। যে নিজেকে হিন্দু বলে, দু-একটি নৈমিত্তিক কর্ম (যেমন শ্রাদ্ধ) সনাতন পদ্ধতিতে সম্পন্ন করে, এবং যার সঙ্গে হিন্দু নামে খ্যাত অন্যান্য লোকের অম্লাধিক। সামাজিক সম্বন্ধ থাকে সেই হিন্দু। আচার ব্যবহার হিন্দুর লক্ষণ নয়। নিত্য নিষিদ্ধ খাদ্য খেলে, বিজাতীয় পোশাক পরলে, সিভিল বিবাহ বা মেম বিবাহ করলে, এবং সম্পূর্ণ নাস্তিক হলেও হিন্দুত্ব বজায় থাকে।
বিলাতের (ব্রিটেনের) অধিকাংশ লোক খ্রীষ্টধর্মের দুই শাখার অন্তর্ভুক্ত প্রোটেস্টান্ট ও রোমান ক্যাথলিক। প্রথম শাখার লোকই বেশী, কিন্তু তাদের মধ্যেও নানা সম্প্রদায় আছে এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র চার্চ বা ধর্মর্সংঘ আছে। সর্বাপেক্ষা প্রতিপত্তিশালী সংঘ চার্চ অভ ইংলান্ড। বিভিন্ন প্রোটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের ক্রীডের প্রধান অংশ এক হলেও খুঁটিনাটি নিয়ে বিবাদ আছে, সেজন্য প্রত্যেক সম্প্রদায়ের গির্জা আলাদা, পাদরী-নিয়োগের পদ্ধতিও আলাদা। কিন্তু ক্যাথলিকদের দলাদলি নেই, বিলাতের তথা সকল দেশের ক্যাথলিক একই ধর্মর্সংঘের অন্তর্গত এবং ধর্মকর্মে পোপের শাসনই চূড়ান্ত বলে মানে।
ব্রিটিশ রাজ্যে সকল ধর্মাবলম্বী নানা বিষয়ে সমান অধিকার ভোগ করলেও চার্চ অভ ইংলান্ডের প্রতি কিছু পক্ষপাত করা হয়। পূর্বে এই সংঘ যে সরকারী অর্থসাহায্য পেত তা এখন বন্ধ হয়েছে, কিন্তু সংঘের সম্পত্তি নানাপ্রকার কর থেকে মুক্ত। চার্চ অভ ইংলান্ডের অনেক বিশপ হাউস অভ লর্ডস-এ সদস্যরূপে আসন পান। ব্রিটেনকে লোকায়ত রাষ্ট্র বা secular state বলা চলে না, অন্তত ভারতের সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র স্বীকৃত। হয়েছে বিলাত তেমন নয়। বিলাতের রাজাই চার্চ অভ ইংলান্ডের প্রধান, তার অন্যতম উপাধি Defender of the Faith। পাকিস্তানী নেতারা যেমন রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ইসলামী নীতির প্রতিষ্ঠা চান, ব্রিটিশ নেতারাও তেমনি বলে থাকেন যে Christian Ideal না মানলে রাষ্ট্রের মঙ্গল নেই। বিলাতী রেডিওতে প্রত্যহ যে ধর্মকথা প্রচারিত হয় তা প্রধানত প্রোটেস্টান্ট খ্রীষ্টধর্ম, ক্যাথলিক প্রভৃতি সম্প্রদায় বিশেষ প্রশ্রয় পান না। কয়েক বৎসর থেকে নাস্তিক, অজ্ঞাবাদী (agnostic) ও যুক্তিবাদী (rationalist) সম্প্রদায় তর্ক করছেন যে ব্রিটিশ প্রজা কেবল প্রোটেস্টান্ট নয়, কেবল খ্রীষ্টানও নয়। বিশ্বাসী অবিশ্বাসী নানা সম্প্রদায় বিলাতে বাস করে, তারা নিজ নিজ মত প্রচারের অধিকার পাবে না কেন? প্রবল আন্দোলনের ফলে কর্তারা নিতান্ত অনিচ্ছায় অখ্রীষ্টান যুক্তিবাদী সম্প্রদায়কেও কিছু কিছু প্রচারের অধিকার সম্প্রতি দিয়েছেন। পাদরীরা তাতে মোটেই খুশী হন নি।