সজ্ঞানে শব্দের অপপ্রয়োগ করতে কেউ চায় না, কিন্তু মহামহা পণ্ডিতেরও ভুল হতে পারে। প্রখ্যাতনামা নমস্য লেখকের ভুল হলে খাতির করে বলা হয় আর্যপ্রয়োগ, কিন্তু সেই প্রয়োগ প্রামাণিক বলে গণ্য হয় না। ভুল জানতে পারলে অনেকে তা শুধরে নেন, কিন্তু যাঁর অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেছে তিনি ছাড়তে চান না। ভুল প্রয়োগের সমর্থনে অনেক সময় কুযুক্তি শোনা যায়। বাংলায় চলন্ত আর পাহারা আছে কিন্তু অনেকে তাতে তুষ্ট নন, সংস্কৃত মনে করে চলমান আর প্রহরা লেখেন। যখন শোনেন যে সংস্কৃত নয় তখন বলেন, বাংলা স্বাধীন ভাষা, সংস্কৃতের দাসী নয়; চলমান আর প্রহরা শ্রুতিমধুর, অতএব চলবে। কার্যকরী স্ত্রীলিঙ্গ, কিন্তু বোধ হয় সুমিষ্ট, তাই কার্যকরী উপায়, কার্যকরী প্রস্তাব ইত্যাদি অপপ্রয়োগ আজকাল খবরের কাগজে খুব দেখা যায়।
কর্মসূত্রে স্থানে কর্মব্যপদেশে, ধূমজাল স্থানে ধূম্রজাল, শয়িত বা শয়ান স্থানে শায়িত, প্রসার স্থানে প্রসারতা, কৌশল বা পদ্ধতি অর্থে আঙ্গিক, প্রামাণিক অর্থে প্রামাণ্য, ক্ষীণ বা মিটমিটে অর্থে স্তিমিত .. ইত্যাদি অশুদ্ধ প্রয়োগ আধুনিক রচনায় প্রচুর দেখা যায়। এই সব শব্দের বদলে শুদ্ধ শব্দ লিখলে রচনার মিষ্টত্বের লেশমাত্র হানি হয় না। ভাষার শুদ্ধিরক্ষার জন্য সতর্কতা আবশ্যক–এ কথা শুনলে নিরঙ্কুশ লেখকরা খুশী হন না। তাদের মনোভাব বোধ হয় এই–যা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে এবং আর পাঁচজনেও যা লিখছে তা অশুদ্ধ হলেও মেনে নিতে হবে। আমি যদি গলা-ধাক্কা অর্থে গলাধঃকরণ লিখে ফেলি এবং আমার দেখাদেখি অন্যেও তা লিখতে আরম্ভ করে তবে সেই নূতন অর্থই মানতে হবে।
ইংরেজীর প্রভাব— ইংরেজী অতি সমৃদ্ধ ভাষা। মাতৃভাষার অভাব পূরণের জন্য সাবধানে ইংরেজী থেকে শব্দ আর ভাব আহরণ করলে কোনও অনিষ্ট হবে না। কিন্তু যা আমাদের আছে তাকে অবহেলা করে যদি বিদেশী শব্দ বা বাক্যের নকল চালানো হয়, তবে অনর্থক দৈন্য প্রকাশ পাবে এবং মাতৃভাষা বিকৃত হবে। Medium-এর প্রতিশব্দ মাধ্যমএর প্রয়োজন আছে, যথাস্থানে তার প্রয়োগ সার্থক। কিন্তু ইংরেজী বাক্যরীতির অনুকরণে লেখা হয়–বাংলা ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানশিক্ষা। বাংলায় বিজ্ঞানশিক্ষা লিখলে হানি কি? সম্প্রতি দেখেছি–এই সভায় অনেক ব্যক্তিত্বর সমাগম হয়েছিল। ইংরেজী personalityর আক্ষরিক অনুবাদ না করে বিশিষ্ট ব্যক্তির সমাগম লিখলে কি চলত না? Promise আর signatureএর বিশেষ অর্থে প্রতিশ্রুতি আর স্বাক্ষরএর অপ্রয়োগ আজকাল খুব দেখা যায়। নারীমাত্রেই মাতৃত্বের প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন। এই গ্রন্থে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। একজনের লেখায় দেখেছি–সে এই অপমানের বিজ্ঞপ্তি নিল না (অর্থাৎ took no notice)। এই রকম অন্ধ অনুকরণ যদি চলতে থাকে তবে বাংলা ভাষা শীঘ্রই একটা উৎকট সংকর ভাষায় পরিণত হবে।
উচ্ছ্বাস ও আড়ম্বর— নীরদ চৌধুরীর বহু বিতর্কিত ইংরেজী বইএ এই রকম একটা কথা আছে–বাঙালী বিনা আড়ম্বরে কিছু লিখতে পারে না। যুদ্ধ বেধেছে, এই সোজা কথার বদলে লিখবে-রুদ্র তার প্রলয়নাচন নাচতে আরম্ভ করেছেন। চৌধুরী মহাশয় কিছু অত্যুক্তি করেছেন, কিন্তু তার অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন নয়। বাংলা কাগজে আগুন লাগা বা অগ্নিকাণ্ডর খবর লেখা হয়–বৈশ্বানরের তাণ্ডবলীলা। জলে ডুবি বা জলমজ্জনকে বলা হয় সলিল সমাধি। ব্যর্থ হইল লিখলে যথেষ্ট হয় না, লেখা হয়–ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল। বাংলাভাষী স্থানে লেখা হয় বাংলাভাষা-ভাষী। সরল ভাষায় বক্তব্য প্রকাশ করতে অনেকে পারেন না।
বিজ্ঞানদর্শনাদির আলোচনায় উচ্ছ্বসিত ভাষা অনর্থকর। বক্তব্য সহজে বোঝা যাবে মনে করে অনেকে অতিরিক্ত রূপক বা কাব্যিক ভাষা প্রয়োগ করেন।–কোষ্ঠকাঠিন্য জীবাণুর পক্ষে বন্ধুর কাজ করে। যে অণুর মধ্যে যত প্রকারের স্বাভাবিক কাঁপন, তত রকম ভাবে এক একটা আলোকরুণার থেকে কাঁপন চুরি যেতে পারে। যারা বাংলায় বিজ্ঞান লিখবেন তাদের বাগাড়ম্বর পরিহার করে স্পষ্টতা আর শৃঙ্খলিত যুক্তির উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। বিজ্ঞান-দর্শনের প্রসঙ্গে কবিত্বের ঈষৎ স্পর্শ একমাত্র রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর রচনায় সার্থক হয়েছে। যারা স্কুল কলেজের জন্য বিজ্ঞানের বই লিখবেন তাদের সেরকম চেষ্টা না করাই ভাল।
বাঙালীর হিন্দীচর্চা
পনর বৎসর পরে হিন্দী রাষ্ট্রভাষা হবে এই সংকল্প ভারতীয় সংবিধানে গৃহীত হওয়ায় অনেকে রাগ করেছেন, আরও অনেকে ভয় পেয়েছেন, কিন্তু অধিকাংশ বাঙালী উদাসীন হয়ে আছেন। পনর বৎসর দেখতে দেখতে কেটে যাবে, অতএব রাগের বশে হিন্দীকে বয়কট করা, ভয় পেয়ে নিরাশ হওয়া, অথবা পরে দেখা যাবে এই ভেবে নিশ্চেষ্ট থাকা–কোনওটাই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কেউ কেউ মনে করেন, পনর বৎসর পরেও সরকারী সকল কার্য হিন্দী ভাষায় নির্বাহ করা যাবে না, তখন ইংরেজীর মেয়াদ আরও বাড়াতে হবে; হয়তো কোনও কালেই ইংরেজী-বর্জন চলবে না। এই রকম ধারণার বশে নিরুদ্যম হয়ে থাকাও হানিকর। অচির ভবিষ্যতে হিন্দী রাষ্ট্রভাষা হবেই–এই সম্ভাবনা মেনে নিয়ে এখন থেকে আমাদের প্রস্তুত হওয়া কর্তব্য।
এ পর্যন্ত আমরা মাতৃভাষা ছাড়া প্রধানত শুধু একটি ভাষা শেখবার চেষ্টা করেছি–ইংরেজী। যাঁরা অধিকন্তু সংস্কৃত ফারসী ফ্রেঞ্চ জার্মন প্রভৃতি শেখেন তাদের সংখ্যা অল্প। ইংরেজী শেখার উদ্দেশ্য তিনটি–জীবিকানির্বাহ, ভিন্নদেশবাসীর সঙ্গে কথাবার্তা, এবং নানা বিদ্যায় প্রবেশ লাভ। হিন্দী যখন রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত হবে তখন কেবল ইংরেজির সাহায্যে জীবিকানির্বাহ চলবে না; সরকারী চাকরি, ওকালতি প্রভৃতি বৃত্তি, এবং সামরিক ও রাজনীতিক কার্যে হিন্দী অপরিহার্য হবে। ভারতের অন্য প্রদেশবাসীর সঙ্গে প্রধানত হিন্দীতেই আলাপ করতে হবে। কিন্তু যাঁরা উচ্চশিক্ষা চান অথবা পৃথিবীর সকল দেশের সঙ্গে যোগ রাখতে চান তাদের অধিকন্তু ইংরেজীও শিখতে হবে। মোট কথা, এখন যেমন ইতর ভদ্র অনেক লোক ইংরেজী না শিখেও কৃষি শিল্প কারবার বা কায়িক শ্রম দ্বারা জীবিকানির্বাহ করে, ভবিষ্যতে হিন্দী না শিখেও তা পারবে। কিন্তু শিক্ষিত শ্রেণীর অধিকাংশ লোক যেসব বৃত্তিতে অভ্যস্ত তা বজায় রাখার জন্য হিন্দী শিখতেই হবে। তা ছাড়া অল্পাধিক ইংরেজীও চাই। অর্থাৎ, এক শ্রেণীর শুধু মাতৃভাষা আর এখনকার মতন নামমাত্র বাজারী হিন্দী জানলেই চলবে; আর এক শ্রেণীর মাতৃভাষা ছাড়া ভালরকম হিন্দী এবং একটু ইংরেজী জানলেই চলবে; এবং উচ্চশিক্ষার্থীর অধিকন্তু ইংরেজী উত্তমরূপে আয়ত্ত করতে হবে।