বিদ্যালয়ে ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিত–এ কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়। যে ধর্ম সমাজ ও রাষ্ট্রের হিতকর এবং জাতিচরিত্রের উন্নতিসাধক, সেই সর্বসম্মত সর্বাঙ্গীণ ধর্মই আমাদের লোকায়ত (secular) রাষ্ট্রের বিদ্যালয়ে শেখানো যেতে পারে। শিক্ষকরাই এই ভার নেবেন, ছাত্রের বাল্যকাল থেকেই তাকে বিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক আর রাষ্ট্রীক কর্তব্য শেখাবেন। এখন যারা অল্পবয়স্ক, ভবিষ্যতে তারাই রাষ্ট্র চালাবে, তাদের শিক্ষা আর চরিত্রগঠনের ব্যবস্থায় বিলম্ব করা চলবে না। যখন শ্রমিকের দল ধর্মঘট করে তখন উপস্থিত সংকট থেকে উদ্ধার পাবার জন্য সরকার বা কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে রফা করেন, অনিচ্ছায় বহু অর্থ ব্যয় করেন। এই অর্থের হয়তো আরও সৎপ্রয়োগ হতে পারত। কিন্তু শিক্ষকদের কর্মের ফল সদ্য দেখা যায় না, সে কারণে সরকার বোঝেন না যে রাষ্ট্রের অন্যান্য বহু শাখাকে বঞ্চিত করেও শিক্ষককে তুষ্ট রাখতে হবে, যাতে তার অভাব না থাকে এবং শিক্ষার কার্যে তিনি পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করতে পারেন।
জীবনযাত্রা
সরল জীবন ও মহৎ চিন্তা, plain living and high thinking–এই বাক্যটি এক কালে খুব শোনা যেত। এখন তার বদলে শোনা যায়– জীবনযাত্রার মান বা standard of living বাড়াতে হবে। এই দুই আপাতবিরোধী বাক্যের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে কি? উচ্চ চিন্তার ব্যাঘাত না করেও জীবনযাত্রা কতটা সরল করা যায়? তার নিম্নতম মান কি?
গ্রীক সন্ন্যাসী ডায়োজিনিস একটা পিপের মধ্যে রাত্রিযাপন করতেন, দিনের বেলা বাইরে এসে রোদ পোয়াতেন। বোধ হয় তার পরিধেয় কিছু ছিল না এবং লোকে দয়া বা ভক্তি করে যা দিত তাতেই তাঁর ক্ষুন্নিবৃত্তি হত। এই রিক্ত জীবনযাত্রা তার উচ্চ চিন্তার বাধা হয় নি। বাংলায় উঞ্ছ শব্দ হীন নীচ বা তুচ্ছ অর্থে চলে। কিন্তু এর মূল অর্থ ক্ষেত্রে পতিত ধান্যাদি খুঁটে নেওয়া, অর্থাৎ অত্যল্প উপকরণে জীবিকানির্বাহ। মহাভারতে উঞ্ছবৃত্তিব্রতধারীর অনেক প্রশংসা পাওয়া যায়। শান্তিপর্বে আছে–এক উথুব্রতী সমাধিনিষ্ঠ অনাসক্ত ব্রাহ্মণ ফলমূল জীর্ণপত্র ও বায়ু ভক্ষণ করে সর্বভূতের হিতসাধনে রত থাকতেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রবল নৈয়ায়িক বুনো রামনাথের কথা লিখেছেন, যিনি বনের ভিতর ছাত্র পড়াতেন এবং সস্ত্রীক শুধু ভাত আর তেঁতুলপাতার ঝোল খেয়ে প্রাণধারণ করতেন। মহারাজ শিবচন্দ্রের প্রশ্নের উত্তরে ইনি জানিয়েছিলেন যে তার কোনও অনুপপত্তি (অভাব নেই।
যাঁরা নিস্পৃহ সন্ন্যাসী এবং যাঁদের পোষ্য কেউ নেই, অথবা যাঁদের পোষ্যবর্গ অত্যল্পে তুষ্ট, তাদেরও জীবনযাত্রার জন্য কয়েকটি বিষয় আবশ্যক। সর্বাগ্রে চাই সুস্থ সবল শরীর যা ধর্মের আদ্য সাধন, যা না হলে উচ্চ চিন্তা জ্ঞানচর্চা বা সৎকর্ম কিছুই চলে না। আবার স্বাস্থ্যের জন্য যথোচিত খাদ্য বস্ত্র ও আশ্রয় চাই। যে স্বভাবত স্বাস্থ্যবান ও সবল সে যত অল্প উপকরণে জীবনধারণ করতে পারে রুগ্ন বা দুর্বল লোকে তা পারে না।
উচ্চ চিন্তা বা জ্ঞানচর্চা এবং সর্বভূতের হিতসাধন বা লোকসেবা–এই দুইএর অর্থ সেকালে যা ছিল এখন ঠিক তা নেই। একালের আদর্শ অনুসরণের জন্য যে অল্পতম জীবনোপায় বা necessaries of life আবশ্যক তাও বদলে গেছে, সেকালের উঞ্ছত এখন অসাধ্য। যথোচিত খাদ্য বস্ত্র ও আশ্রয় ছাড়াও কতকগুলি বিষয়ের ব্যবস্থা না হলে জীবনযাত্রা চলে না।
অত্যল্পে তুষ্ট লোকের সংখ্যা চিরকালই কম, সাধারণ মানুষ ভোগবিলাস চায়। অনেক বিলাসী লোকেও জ্ঞানচর্চা ও লোকসেবা করে, অনেক অবিলাসী লোকেরও উচ্চ চিন্তা ও সৎকর্মের প্রবৃত্তি থাকে না। তথাপি দেখা যায়, ভোগী অপেক্ষা ত্যাগী লোকেই অধিকতর লোকহিতৈষী হয়। এই কারণে সরল জীবন ও মহৎ চিন্তা সর্ব দেশে সর্বকালে মানুষের শ্রেষ্ঠ আদর্শরূপে গণ্য হয়েছে।
অধিকাংশ ভারতবাসীর জীবনোপায় পর্যাপ্ত নয়। আদর্শের অনুসরণ দূরের কথা, বেঁচে থাকাই অনেকের পক্ষে দুঃসাধ্য, অন্নচিন্তা ছাড়া অন্য চিন্তার অবসর নেই। কোনও লোক জ্ঞানচর্চা ও লোকসেবা করুক বা না করুক, সে রাজপুরুষ ব্যবসায়ী বিজ্ঞানী শিক্ষক কলাবিৎ কৃষক বা মজুর যাই হক, মনুষ্যোচিত জীবনযাত্রার জন্য কতকগুলি বিষয় তার অবশ্যই চাই, এ সম্বন্ধে দ্বিমত নেই। কিন্তু মনুষ্যোচিত জীবনযাত্রার নিম্নতম মান কি? দেশভেদে শীতাতপ প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণে জীবনোপায়ের ভেদ হবে। বৃত্তিভেদেও কিছু কিছু পরিবর্তন হবে, শ্রমিকের আহার আশ্রমিকের সমান হলে চলবে না। এই রকম বিশেষ বিশেষ প্রয়োজন মেনে নিয়েও সর্বসাধারণের জন্য জীবনযাত্রার নিম্নতম মান নির্ধারণ করা যেতে পারে কি? ফর্দ করে বা অঙ্কপাত করে দেখানো বোধ হয় অসম্ভব, কিন্তু জীবনযাত্রার যা প্রধান মাপকাঠি–স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের বোধ, তার দ্বারা একটা স্কুল ধারণা করা যেতে পারে।
যে ব্যবস্থায় মধ্যবিত্তের বা ধনী-দরিদ্রের মাঝামাঝি লোকের (যাদের আধুনিক নাম বুর্জোআ) স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের বোধ কোনও রকমে বজায় থাকে তাকেই আপামর জনসাধারণের জীবনযাত্রার নিম্নতম মান ধরা যেতে পারে। আমার জন্ম মধ্যবিত্ত সমাজে। বিগত ষাট-সত্তর বৎসরে এই সমাজে জীবনযাত্রার এবং তার সঙ্গে স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধের যে পরিবর্তন দেখেছি তা বিচার করলে হয়তো মান নির্ধারণের সূত্র পাওয়া যাবে। এই দীর্ঘকালের গোড়ার দিকে উত্তর বিহারের একটা মাঝারি শহরে ছিলাম। বিহারীর তুলনায় সমশ্রেণীর বাঙালীর জীবনযাত্রায় আড়ম্বর বেশী ছিল। যে ভদ্র বাঙালী মাসে কুড়ি-পঁচিশ টাকা রোজগার করতেন তারও অন্নবস্ত্র আর বাসস্থানের অভাব হত না। আমাদের বাড়িতে আধুনিক আসবাব ছিল না, শুধু অনেকগুলো তক্তাপোশ আর গোটাকতক বেঢপ টেবিল চেয়ার আলমারি ছিল। জলের কল বিজলী বাতি ছিল না। পায়খানা অনেক দূরে, বর্ষায় ছাতা মাথায় দিয়ে যেতে হত। লোকে কদাচিৎ ঔষধার্থে চা খেত। সিগারেট তখন নূতন উঠেছে, গুটিকতক বড়লোকের ছেলে লুকিয়ে খেত, বয়স্থরা প্রায় সকলেই তামাক খেতেন। সুগন্ধ মাথার তেল দাঁতের মাজন প্রভৃতি প্রসাধন দ্রব্যের চলন ছিল না। বাইসিকেল ফাউন্টেন পেন হাতঘড়ি ছিল না, যারা ভাল চাকরি করত কেবল তাদেরই পকেটঘড়ি থাকত। ফুটবল আর ক্রিকেট শুধু নামেই জানা ছিল। আমোদের ব্যবস্থা কালীপুজোর সময় শখের থিয়েটার, কালেভদ্রে যাত্রা, আর কয়েকটি বাড়িতে গান গল্প: তাস পাশা দাবার আজ্ঞা। সাপ্তাহিক বঙ্গবাসীতে দেশবিদেশের যে খবর থাকত তাতেই সাধারণ ভদ্রলোকের কৌতূহল নিবৃত্ত হত। বাংলা গল্প প্রবন্ধ আর কবিতার বই খুব কম ছিল, পাওয়া গেলে নিকৃষ্ট বইও লোকে সাগ্রহে পড়ত। তখনকার প্রধান বিলাসিতা ছিল ভাল জিনিস খাওয়া।