সমাজের সংকট ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে, মামুলী ব্যবস্থায় তা বেশী দিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অশুভস্য কালহরণ নীতি গ্রহণ করে নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকলে অশুভ দ্রুতবেগে এগিয়ে আসবে। যে ধর্ম সমাজকে ধারণ করে, প্রজাবর্গের অত্যন্ত হিত করে, এবং দুঃখতপ্তগণের আর্তিনাশ করে, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের উপযোগী সেই সমঞ্জস ধর্মের তত্ত্ব অতিশয় দুরূহ, কিন্তু তার অন্বেষণ উপেক্ষা করা চলবে না।
জাতিচরিত্র
ভাইকাউন্ট স্যামুএল একজন বিখ্যাত দার্শনিক ও রাজনীতিক। এককালে সার হারবার্ট স্যামুএল নামে ইনি ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলেন। সম্প্রতি তিরাশি বৎসরে পদার্পণ করে ইনি পার্লামেন্টে হাউস অভ লর্ডসে নিজ দেশের নৈতিক অবস্থা (The State of Britains Morals) সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দিয়েছেন। তার ভাবার্থ এই
ব্রিটেনের রাজনীতিক আর্থনীতিক আন্তর্জাতিক প্রভৃতি নানা সমস্যা আছে, কিন্তু সবচেয়ে চিন্তার বিষয় আমাদের জাতীয় চরিত্র। যাঁরা এসম্বন্ধে খবর রাখেন তাদের অনেকে উদবিগ্ন হয়ে পড়েছেন। ব্রিটিশ জাতির সাহস ও দেশপ্রেম পূর্ণমাত্রায় আছে। আমাদের নির্বাচক মণ্ডলে যে তিন কোটি ভোটদাতা আছে তাদের বুদ্ধি ও কর্তব্যনিষ্ঠা পূর্বের তুলনায় বেড়েছে ছাড়া কমেনি। কিন্তু দেশবাসীর এক অংশের যে চারিত্রিক অবনতি দেখা যাচ্ছে তা মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। আমাদের বড় বড় শহরে যেসব দুষ্কিয়ার আচ্ছা আছে তা ব্রিটিশ সভ্যতার কলঙ্ক। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে কিছুকাল এদেশে অপরাধীর সংখ্যা এত কমে গিয়েছিল যে অর্ধেক জেলখানা বন্ধ রাখলেও চলত। কিন্তু এখন তার উলটো হয়েছে, বিশেষত অল্পবয়স্ক অপরাধীর সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে। খবরের কাগজে প্রতিদিন যেসব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিবরণ ছাপা হয় তা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত লজ্জা ও ক্ষোভের বিষয়। পূর্বের তুলনায় লাম্পট্য খুব বেড়ে গেছে, ব্যভিচার তুচ্ছ পরিহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিবাহভঙ্গ এখন একটা নিত্যনৈমিত্তিক সামান্য ঘটনা বলে গণ্য হয়। আরও ভয়ানক কথা–the vices of Sodom and Gomorrah appear to be rife among us। বাইবেলে আছে, ভূমিকম্প আর অগ্ন্যুৎপাতে এর প্রায়শ্চিত্ত হয়েছিল। এখন তা হবার নয়, কিন্তু বর্তমান সমাজে এই পাপের পরিণাম আরও মারাত্মক ভাবে দেখা দেবে, আমাদের ধর্মবুদ্ধি বিষাক্ৰান্ত হবে। অনেকে মনে করেন এসব কথা সাধারণের আলোচ্য নয়। কিন্তু ধর্মনীতি যদি ক্ষুণ্ণ হয় তবে সমগ্র জাতিকে তার ফলভোগ করতে হবে। স্বর্গ নরক সম্বন্ধে জনসাধারণের পূর্বে যে ধারণা ছিল তা এখন নেই, দুই মহাযুদ্ধের ফলে বিধাতার মঙ্গলময় বিধানেও লোকের আর আস্থা নেই। শারীরবিদ্যা আর মনোবিদ্যার নূতন নূতন মতবাদের ফলে আমাদের ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ কমে গেছে। এখন শোনা যায়, প্রত্যেক মানুষের আচরণ তার জন্মগত gene সমূহের (আদিম জন্মকোষের কতকগুলি অতি সূক্ষ্ম উপাদানের) ফল, অতএব বেশী দোষ ধরা ঠিক নয়, মানুষের ব্যক্তিগত ত্রুটি উদার ভাবে বিচার করাই উচিত।
পরিশেষে স্যামুএল বলেছেন, আমাদের সদাচার বা কদাচারের মূলে আছে ব্যক্তিগত আদিম জন্মকোষের বৈশিষ্ট্য–এইটেই সব কথা নয়। যে সামাজিক পরিবেশে আমরা জন্মগ্রহণ করি তার রীতিনীতি এবং লোকমত অনুসারেই আমাদের চরিত্র প্রধানত গঠিত হয়। সকল দেশের মানবসমাজের বহু যুগের চিন্তার ফলে যা উদ্ভূত হয়েছে সেই সর্বজনীন ধর্মনীতি অবলম্বন করাই শ্রেয়স্কর–এই সহজ বুদ্ধি আমাদের ফিরে আসা আবশ্যক।
.
ফরাসী আর মার্কিন জাতির দোষও অনেক পত্রিকায় আলোচিত হয়। ফ্রান্সের মন্ত্রিসভা স্থায়ী হয় না তার কারণ ফরাসী জাতি অব্যবস্থিতচিত্ত। শাসকবর্গের অসাধুতা লাম্পট্য আর অকর্মণ্যতার জন্যই গত যুদ্ধে পরাজয় ঘটেছিল। সম্প্রতি Earnest Raynaud নামক একজন ফরাসী সম্পাদক New York Times পত্রিকায় লিখেছেন–সুরাসক্তিতে ফরাসী জাতি অদ্বিতীয়, মেয়ে পুরুষ ছেলে বুড়ো মিলে প্রতি বৎসরে যা উদরস্থ করে তাতে খাঁটি আলকোহলের পরিমাণ দাঁড়ায় জন পিছু গড়ে সাত গ্যালন (প্রায় ৮৪ বোতল ব্রান্ডি বা হুইস্কির সমান)। ফ্রান্সের এক পঞ্চমাংশ লোক মদ তৈরি বা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই দেশব্যাপী সুরাপ্লাবন রোধ করবার চেষ্টা মাঝে মাঝে হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রপরিষদে শৌণ্ডিকরাই সর্বেসর্বা, তাদের অমতে কিছু করা সরকারের অসাধ্য। খবরের কাগজ নীরব, কারণ অপ্রিয় সত্য লিখলেই বিজ্ঞাপনের আয় বন্ধ হবে। সম্প্রতি একজন মন্ত্রী মদ্যপতিদের দমন করতে গিয়ে পদচ্যুত হয়েছেন।
কয়েক মাস পূর্বে Times Literary Supplementএ আমেরিকার নাগরিক জীবনের কঠোর সমালোচনা ছাপা হয়েছে। জুয়া জুলুম আর ধনবাহুল্য–এই হচ্ছে মার্কিন সভ্যতার অঙ্গ। ধনীরা আত্মরক্ষার জন্য গ্যাংস্টার বা গুণ্ডাদের টাকা দিয়ে ঠাণ্ডা রাখে। রাষ্ট্রচালনার সকল ক্ষেত্রে ঘুষ চলে, সেনেটর জজ মেয়র শেরিফ সেনাপতি কেউ বাদ যান না। ধনী অপরাধীরা অনায়াসে আইনকে ফাঁকি দিতে পারে। ..ইত্যাদি।
.
বড় বড় পাশ্চাত্ত্য জাতির দোষের ফর্দ শুনে আমাদের উৎফুল্ল হবার কারণ নেই। আমরা শান্ত শিষ্ট সোনার চাঁদ, নৃশংসতা ব্যভিচার লাম্পট্য সুরাসক্তি আমাদের মধ্যে কম, অতএব আমাদের ভবিষ্যৎ অতি উজ্জ্বল–এমন মনে করা ঘোর মূর্খ। বৃহৎ রাষ্ট্রীয় ব্যাপারের জন্য জওহরলাল আছেন, বিধান রায় আছেন, তাদের শায়েস্তা রাখার জন্য কমিউনিস্ট প্রজা-সোশালিস্ট প্রভৃতি দল আছে, দুর্মুখ খবরের কাগজ আছে, অতএব আমরা রাম-শ্যাম যদুর দল নিশ্চিন্ত হয়ে যা পারি রোজগার করব আর অবসর কালে সিনেমা ফুটবল নাচ গান গল্প উপন্যাস সর্বজনীন পুজো প্রভৃতি সংস্কৃতিচর্চায় মেতে থাকব–এই মনোবৃত্তি অনর্থকর। যে স্বাধীনতা আমরা সাত শ বছর পরে অতি কষ্টে পেয়েছি তা বজায় রাখতে পারব কিনা, ব্রিটিশ ভারতের চাইতে সমৃদ্ধতর ভারত গড়তে পারব কিনা–এসব প্রশ্নের উত্তর এখনও দেওয়া যায় না। আমরা, অর্থাৎ দেশের জনসাধারণ যদি নিজের অসংখ্য ত্রুটি শোধনের চেষ্টা না করি এবং প্রজার কর্তব্যে অবহেলা করি তবে কোনও রাষ্ট্রনেতা বা রাজনীতিক দল আমাদের রক্ষা করতে পারবেন না।