তখন পূর্বদিকে নব কৃষ্ণপক্ষের পূর্ণপ্রায় চন্দ্র ধীরে ধীরে সমুদ্রশয়ন থেকে উঠে আসছে। এই তীররেখাশূন্য জলময় মহামরুর পূর্বসীমান্তে উদয়পথের ঠিক নিচে থেকে আমাদের জাহাজ পর্যন্ত অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে প্রশস্ত দীর্ঘ আলোকপথ ঝিকমিক করছে। জ্যোৎস্নাময়ী সন্ধ্যা কোন এক অলৌকিক বৃন্তের উপরে অপূর্ব শুভ্র রজনীগন্ধার মতো আপন প্রশান্ত সৌন্দর্যে নিঃশব্দে চতুর্দিকে দলপ্রসারণ করল। আর মানুষগুলো পরস্পরকে জড়াজড়ি করে ধরে পাগলের মতো তীব্র আমোদ ঘুরপাক খাচ্ছে, হাঁপাচ্ছে, উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৯
৩ সেপ্টেম্বর। বেলা দশটার সময় সুয়েজখালের প্রবেশমুখে এসে জাহাজ থামল। চারদিকে চমৎকার রঙের খেলা। পাহাড়ের উপর রৌদ্র, ছায়া এবং নীলিম বাষ্প। ঘননীল সমুদ্রের প্রান্তে বালুকাতীরের রৌদ্রদুঃসহ গাঢ় পীত রেখা।
খালের মধ্যে দিয়ে জাহাজ সমস্ত দিন আতি ধীর গতিতে চলছে। দু-ধারে তরুহীন বালুকা। কেবল মাঝে মাঝে এক-একটি ছোটো কোঠাঘর বহুযত্নবর্ধিত গুটিকতক গাছে-পালায় বেষ্টিত হয়ে আরামজনক দেখাচ্ছে।
অনেক রাতে আধখানা চাঁদ উঠল। ক্ষীণ চন্দ্রোলোকে দুই তীর অস্পষ্ট ধু ধু করছে। — রাত দুটো-তিনটের সময় জাহাজ পোর্টসৈয়দে নোঙর করলে।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১০
৪ সেপ্টেমবর। বিকালের দিকে ক্রীট দ্বীপের তটপর্বত দেখা দিয়েছিল। ডেকের উপর একটা স্টেজ বাঁধা হচ্ছে। জাহাজে একদল নাট্যব্যবসায়ী যাত্রী আছে, তারা অভিনয় করবে। অন্যদিনের চেয়ে সকাল-সকাল ডিনার খেয়ে নিয়ে তামাশা আরম্ভ হল। প্রথমে যাত্রীদের মধ্যে যারা গানবাজনা কিঞ্চিৎ জানেন এবং জানেন না, তাঁদের কারো বা দুর্বল পিয়ানোর টিং টিং কারো বা মৃদু ক্ষীণকণ্ঠে গান হল। তার পরে যবনিকা উদ্ঘাটন করে নটনটি কর্তৃক “ব্যালে’ নাচ’ সং নিগ্রোর গান, জাদু, প্রহসন, অভিনয় প্রভৃতি বিবিধ কৌতুক হয়েছিল। মধ্যে নাবিকাশ্রমের জন্যে দর্শকদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ হল।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১১
৬ সেম্পেম্বর। খাবার ঘরে খোলা জানলার কাছে বসে বাড়িতে চিঠি লিখছি। একবার মুখ তুলে বামে চেয়ে দেখলুম “আয়োনিয়া’ দ্বীপ দেখা দিয়েছে। পাহাড়ের কোলের মধ্যে সমুদ্রের ঠিক ধারেই মনুষ্যরচিত ঘনসন্নিবিষ্ট একটি শ্বেত মৌচাকের মতো দেখা যাচ্ছে। এইটি জান্তি শহর (Zanthe)। দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন পর্বতটা তার প্রকাণ্ড করপুটে কতকগুলো শ্বেত পুষ্প নিয়ে সমুদ্রকে অঞ্জলি দেবার উপক্রম করছে।
ডেকের উপর উঠে দেখি আমরা দুই শৈলশ্রেণীর মাঝখান দিয়ে সংকীর্ণ সমুদ্রপথে চলেছি। আকাশে মেঘ করে এসেছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে– ঝড়ের সম্ভাবনা। আমাদের সর্বোচ্চ ডেকের চাঁদোয়া খুলে ফেলে দিলে। পর্বতের উপর অত্যন্ত নিবিড় মেঘ নেমে এসেছে; কেবল দূরে একটিমাত্র পাহাড়ের উপর মেঘছিদ্রমুক্ত সন্ধ্যালোকের একটি দীর্ঘ আরক্ত ইঙ্গিত এসে স্পর্শ করছে, অন্য সবগুলো আসন্ন ঝটিকার ছায়ায় আচ্ছন্ন। কিন্তু ঝড় এল না। একটু বাতাস এবং সবেগ বৃষ্টির উপর দিয়েই সমস্ত কেটে গেল। ভূমধ্যসাগরে আকাশের অবস্থা অত্যন্ত অনিশ্চিত। শুনলুম, আমরা যে পথ দিয়ে যাচ্ছি এখান দিয়ে জাহাজ সচরাচর যায় না। জায়গাটা নাকি ভারি ঝোড়ো।
রাত্রে ডিনারের পর যাত্রীরা কাপ্তেপের স্বাস্থ্যপান এবং গুণগান করলে। কাল ব্রিন্দিসি পৌঁছব। জিনিসপত্র বাঁধতে হবে।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১২
৭ সেপে্ম্বর। আজ সকালে ব্রিন্দিসি পৌঁছনো গেল। মেলগাড়ি প্রস্তুত ছিল, আমরা গাড়িতে উঠলুম।
গাড়ি যখন ছাড়ল তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। আহার করে এসে একটি কোণে জানলার কাছে বসা গেল।
প্রথমে, দুই ধারে কেবল আঙুরের খেত। তার পরে জলপাইয়ের বাগান। জলপাইয়ের গাছগুলো নিতান্ত বাঁকাচোরা, গ্রন্থি ও ফাটলবিশিষ্ট, বলি-অঙ্কিত, বেঁটেখাটো রকমের; পাতাগুলো ঊর্ধ্বমুখ; প্রকৃতির হাতের কাজে যেমন একটি সহজ অনায়াসের ভাব দেখা যায়, এই গাছগুলোয় তার বিপরীত। এরা নিতান্ত লক্ষ্মীছাড়া, কায়ক্লেশে অষ্টাবক্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; এক-একটা এমন বেঁকে ঝুঁকে পড়েছে যে পাথর উঁচু করে তাদের ঠেকো দিয়ে রাখতে হয়েছে।
বামে চষা মাঠ; সাদা সাদা ভাঙা ভাঙা পাথরের টুকরো চষা মাটির মধ্যে মধ্যে উৎক্ষিপ্ত। দক্ষিণে সমুদ্র। সমুদ্রের একেবারে ধারেই এক-একটি ছোটো ছোটো শহর দেখা দিচ্ছে। চার্চচূড়া-মুকুটি সাদা ধবধবে নগরীটি একটি পরিপাটি তন্বী নাগরীর মতো কোলের কাছে সমুদ্র-দর্পণ রেখে নিজের মুখ দেখে হাসছে। নগর পেরিয়ে আবার মাঠ। ভুট্টার খেত, আঙুরের খেত, ফলের খেত, জলপাইয়ের বন; খেতগুলি খণ্ড প্রস্তরের বেড়া দেওয়া। মাঝে মাঝে এক-একটি বাঁধা কূপ। দূরে দূরে দুটো-একটা সঙ্গিহীন ছোটো সাদা বাড়ি।
সূর্যাস্তের সময় হয়ে এল। আমি কোলের উপর এক থোলো আঙুর নিয়ে বসে বসে এক-আধটা করে মুখে দিচ্ছি। এমন মিষ্ট টসটসে সুগন্ধ আঙুর ইতিপূর্বে কখনো খাই নি। মাথায় রঙিন রুমাল বাঁধা ওই ইতালীয়া যুবতীকে দেখে আমার মনে হচ্ছে, ইতালিয়ানীরা এখানকার আঙুরের গুচ্ছের মতো, অমনি একটি বৃন্তভরা অজস্র সুডোল সৌন্দর্য, যৌবনরসে অমনি উৎপূর্ণ,– এবং ওই আঙুরেরই মতো তাদের মুখের রং– অতি বেশি সাদা নয়।
এখন একটা উচ্চ সমুদ্রতটের উপর দিয়ে চলেছি। আমাদের ঠিক নিচেই ডান দিকে সমুদ্র। ভাঙাচোরা জমি ঢালু জলের মধ্যে প্রবেশ করেছে। গোটা চার-পাঁচ পাল-মোড়া নৌকো ডাঙার উপর তোলা। নিচেকার পথ দিয়ে গাধার উপর চড়ে লোক চলেছে। সমুদ্রতীরে কতকগুলো গোরু চরছে– কী খাচ্ছে ওরাই জানে; মাঝে মাঝে কেবল কতকগুলো শুকনো খড়কের মতো আছে মাত্র।