পুরুষ গৌরব বোধ করে যে সে পুরুষ, কারণ সে সব কিছুর প্রভু। অন্ধ, বিকলাঙ্গ, নির্বোধ পুরুষও অধিষ্ঠিত শ্রেষ্ঠ নারীর ওপরে; একটি অন্ধ বিকল নির্বোধি পুরুষও অসহায় ক’রে তুলতে পারে শ্রেষ্ঠ নারীকে। ইহুদিরা ভোরবেলা প্রার্থনা করে, ‘বিধাতাকে ধন্যবাদ, যেহেতু তিনি আমাকে নারী করেন নি’; আর একই সময় তাদের নারীরা কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বলে, ‘বিধাতাকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে তাঁর নিজের ইচ্ছানুসারে সৃষ্টি করেছেন।‘ প্লাতো দু-কারণে তাঁর দেবতাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন; প্রথমত তারা তাকে স্বাধীন মানুষ করেছে, ক্রীতদাস করে নি; দ্বিতীয়ত তাঁকে পুরুষ করেছে, নারী করে নি। কোরানে আছে : ‘পুরুষ নারীর কতা, কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের ওপর বিশিষ্টতা দান করেছেন, আর এ জন্যে যে পুরুষ ধনসম্পদ থেকে ব্যয় করে’ [ দ্র ৪ : ৩৪]। পুরুষ তার সুবিধা শান্তির সাথে ভোগ করার জন্যে দিয়েছে তাকে শাশ্বত ধ্রুব ভিত্তি; তারা তাদের প্রাধান্যকে পরিণত করেছে ঐশী অধিকারে। শুধু পার্থিব পুরুষের শক্তিতে তারা সন্তুষ্ট থাকে নি, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আবিষ্কার করেছে ও কাজে লাগিয়েছে অলৌকিক পরমপুরুষকে। পুরুষেরা বিধান প্রণয়ন করেছে, তাতে একচেট সুবিধা দেয়া হয়েছে পুরুষকে; তারপর তারা নিজেদের বানানো বিধানকে উন্নীত করেছে চিরন্তন নীতিমালায়। তারা মুখর হয়েছে নারীনিন্দায়। তারতুলিয়ান লিখেছেন, ‘নারী, তুমি শয়তানের দ্বার। তুমি তাঁকে বিপথগামী করেছে যাকে শয়তানও সরাসরি আক্রমণের সাহস করে নি। তোমার কারণেই ঈশ্বরের পুত্রকে মরতে হয়েছে; তুমি সব সময় শোকাকুল ও ছিন্নবস্ত্রে থাকবে।‘ সন্ত জন ক্রাইসোসটম বলেছেন, ‘সমস্ত বর্বর পশুর মধ্যেও নারীর মতো ক্ষতিকর আর কিছু নেই।‘ হাদিসে আছে : ‘নারীর চেয়ে ক্ষতিকর কোনো দুৰ্যোগ আমি রেখে যাচ্ছি না’ [দ্র হিউয়েজ (১৮৮৫)] বা ‘পুরুষের পক্ষে নারী অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর বিপদের জিনিস আমি আমার পরে আর কিছু রাখিয়া যাইতেছি না।’ [দ্র নূর মোহাম্মদ (১৯৮৭, ১৮৭)]। কোৎ বলেছেন, নারীত্ব হচ্ছে ‘প্রলম্বিত শৈশব’, যা নারীর মনকে দুর্বল করে রেখেছে। বালজাক লিখেছেন, ‘নারীর নিয়তি ও পরম গৌরব হচ্ছে পুরুষের হৃদয়ে স্পন্দন জাগানো…নারী অস্থাবর সম্পত্তি এবং ঠিকমতো বলতে গেলে নারী হচ্ছে পুরুষের সহায়ক।‘ তিনি আরো বলেছেন, ‘বিবাহিত নারী হচ্ছে ক্রীতদাসী, যাকে সিংহাসনে বসিয়ে রাখতে হবে’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১৪২)]। খুব কম নারীকেই পুরুষ সিংহাসনে বসিয়ে রেখেছে, কিন্তু দাসী ক’রে রেখেছে সবাইকে। এমনকি ক্ষমতাশালী রানীরাও তাদের স্বামীদের কাছে পরিচারিকার মতোই আচরণ করেছে, যেমন রানী ভিক্টোরিয়া। নারীদের মধ্যে কোনো দান্তে নেই, শেক্সপিয়র নেই, মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ নেই, নিউটন-আইনস্টাইন নেই, ভিঞ্চি-পিকাসো নেই, প্লাতো-আরিস্ততল-মার্ক্স নেই, কোনো প্রেরিতপুরুষ তো নেই-ই; কিন্তু সত্য হচ্ছে পুরুষদের মধ্যেও এঁদের মানের লোক বেশি নেই; এবং প্রশ্ন হচ্ছে থাকবে কী করে? নারীরা আজো পুরুষদের থেকে নিকৃষ্ট; এর কারণ এ নয় যে তারা সহজাতভাবেই নিকৃষ্ট, এর কারণ তাদের নিকৃষ্ট হয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের পরিস্থিতিই তাদের নিকৃষ্ট করে রেখেছে। শূদ্ৰদের ক’রে রাখা হয়েছে শূদ্ৰ, তাদের বাধ্য করা হয়েছে নিম্নবৃত্তিতে; কিন্তু এ থেকে সিদ্ধান্তে পোঁছানো যায় না যে শূদ্ররা শুধু নিম্নবৃত্তিরই উপযুক্ত। নারীকে শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে বলা যায় না নারী অশিক্ষিত; তাকে বিজ্ঞান থেকে বহিষ্কার ক’রে বলা যায় না নারী বিজ্ঞানের অনুপযুক্ত। তাকে শাসনকার্য থেকে নির্বাসিত ক’রে বলা যায় না নারী শাসনের যোগ্যতাহীন। নারীর কোনো সহজাত অযোগ্যতা নেই, তার সমস্ত অযোগ্যতাই পরিস্থিতিগত, যা পুরুষের সৃষ্টি বা সুপরিকল্পিত এক রাজনীতিক ষড়যন্ত্র।
লৈঙ্গিক রাজনীতি
নারীপুরুষের অন্তরঙ্গতম সম্পর্ক হচ্ছে সঙ্গম, যাতে একজনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আরেকজন। সব কিছুই রাজনীতি ব’লে যাঁরা মনে করেন, তাঁরাও মাংসের ভেতরে মাংসের অনুপ্রবেশকে রাজনীতি ব’লে মনে করেন না। সঙ্গমক্রিয়াকে দ্য বোভোয়ার (১৯৪, ৫৩-৫৪) বৰ্ণনা করেছেন এভাবে : নারী যখন ইচ্ছুকও হয়, তখনো পুরুষই নারীকে অধিকার করে, নারী অধিকৃত হয়। এটা হয় আক্ষরিকার্থেই, বিশেষ কোনো প্রত্যঙ্গের সাহায্যে বা বলপ্রয়োগে পুরুষ নারীকে কাবু করে, তাকে ঠিকমতো আটকে ধরে; পুরুষই সম্পন্ন করে সঙ্গমের প্রয়োজনীয় অঙ্গসঞ্চালন। পতঙ্গ, পাখি, ও স্তন্যপায়ীদের মাঝে পুরুষ বিদ্ধ করে নারীকে। বিদ্ধকরণের ফলে নারীর অভ্যন্তরতা ধর্ষিত হয়। পুরুষের আধিপত্য প্রকাশ পায় সঙ্গমের আসনেই;– অধিকাংশ প্রাণীর ক্ষেত্রেই পুরুষ থাকে নারীর ওপরে। পুরুষ যে-প্রত্যঙ্গটি ব্যবহার করে সেটি একটি বস্তু, তবে উত্তেজিত অবস্থায় সেটি হয়ে ওঠে হাতিয়ার, কিন্তু নারীর প্রত্যঙ্গটি থাকে এক নিষ্ক্রিয় আধার। বোভোয়ারের বর্ণনায় সঙ্গম হয়ে উঠেছে একধরনের সমর। কিন্তু বোভোয়ার একে যুদ্ধ বলেন নি, বা নারীপুরুষের অন্তরঙ্গতম সম্পর্কের প্রকৃতি বোঝানোর জন্যে ব্যবহার করেন নি এর চেয়েও ভয়ানক শব্দটি- রাজনীতি। কিন্তু সঙ্গমও একধরনের রাজনীতি, তাতে শক্তির আধিপত্য ও অধীনতার সম্পর্ক অত্যন্ত স্পষ্ট। সঙ্গম থেকে নারীপুরুষের সমস্ত সম্পর্ককে একটি তাত্ত্বিক কাঠামোতে ব্যাখ্যা করেছেন কেইট মিলেট তাঁর সেক্সুয়াল পলিটিক্স (১৯৬৯) বা লৈঙ্গিক রাজনীতি গ্রন্থে। দ্য বোভোয়ার দ্বিতীয় লিঙ্গ (১৯৪৯) গ্রন্থে অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন নারীকে, বিশ্বাসও করেছেন তিনি সমাজতন্ত্রে, আশা করেছেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হ’লে নারী তাঁর স্বাধিকার পাবে। পরে হতাশ হয়েছেন, দেখেছেন সমাজতন্ত্রও পুরুষতন্ত্র। বোভোয়াবের বইয়ের ঠিক দু-দশক পরে বেরোয় কেইট মিলেটের লৈঙ্গিক রাজনীতি, যেটি সম্ভবত সব সময়ের সবচেয়ে সাহসী, এবং একমাত্র বেস্টসেলার, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। মিলেট সাহিত্য-সমাজ-সভ্যতা ঘেঁটে দেখিয়েছেন যে নারীপুরুষের অন্তরঙ্গতম সম্পর্ক থেকে চরম বাহ্যিক সম্পর্ক হচ্ছে শক্তির সম্পর্ক, যার নাম তিনি দিয়েছেন লৈঙ্গিক রাজনীতি। কেইট মিলেট তীব্র, তীক্ষু, প্রখর ও প্রচণ্ড; এবং বিস্ময়করভাবে মননশীল।