পুরোনো কুসংস্কারকে বিজ্ঞানের রূপ দিয়েছেন আদিম পিতৃতন্ত্রের এক প্রখ্যাত ও প্রভাবশালী উত্তরপুরুষ। তার নাম সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তিনি অর্জন করেছেন আধুনিক কালের অন্যতম স্রষ্টার মহিমা; উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নিজের সমস্ত কালো কুসংস্কারকে বিজ্ঞানের মুখোশ পরিয়ে উপস্থিত করেছেন তিনি, তাই তাঁকে কেউ হেসে উড়িয়ে দিতে পারে নি, বরং কুসংস্কারের বৈজ্ঞানিক রূপ দেখে শান্তি বোধ করেছে। ফ্রয়েডের মতে, নারী হচ্ছে এমন মানুষ যার কোনো একটি প্রত্যঙ্গ হারিয়ে গেছে। একে তিনি বলেছেন ‘খোজাগূঢ়ৈষা’। কোন মহান প্রত্যঙ্গটি হারিয়েছে? নারী হারিয়ে ফেলেছে তার ‘শিশ্ন’। প্রায় সব আদিম সমাজই শিশ্নের মহিমায় বিশ্বাস করে; পুরুষের শিশ্ন তাদের চোখে লাঙ্গল, যা কর্ষণ করে, আর নারীর যোনি হচ্ছে জমিতে লাঙলের দাগ। সংস্কৃতে ‘লাঙ্গল’ আর ‘লিঙ্গ’ একই ধাতু থেকে উৎপন্ন শব্দ। ‘সীতা’ ও ‘রাম’-এর মতো পবিত্ৰ শব্দও আসলে যোনি ও লিঙ্গের ধারণা বহন করে। ‘সীতা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘হলরেখা’ বা ‘লাঙ্গলের ফলার দাগ’, আর ‘রাম’ শব্দটি এসেছে ‘রম’ ধাতু থেকে, যার এক অর্থ ‘চাষ করা, কর্ষণ করা’, ও আরেক অর্থ ‘রমণ’ [ দ্র নরেন্দ্রনাথ (১৯৭৫, ১০০, ১১০)]। তাই আদিম কাল থেকেই পুরুষের চোখে লিঙ্গই সম্রাট। পুরুষের বড়ো গৌরবের ধন তার দু-উরুর মধ্যস্থলে আন্দোলিত প্রত্যঙ্গটি, যার সাহায্যে সে পৃথিবীকে পর্যুদস্ত করে আসছে। সে রাজা, ওটি তার রাজদণ্ড। নারী যেহেতু হারিয়ে ফেলেছে রাজদণ্ড, তাই ফ্রয়েডের মতে নারীস্বভাবের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘শিশ্নাসূয়া’; অৰ্থাৎ নারীর জীবন কাটে নিরন্তর পুরুষাঙ্গটিকে ঈর্ষা করে। শিশ্নাসূয়া ধারণার মধ্য দিয়ে আদিম বিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানরূপে। ফ্রয়েড যাকে নির্দেশ করেছিলেন নারীর শাশ্বত বৈশিষ্ট্য ব’লে, সে-খোজাগূঢ়ৈষার উৎপত্তি তাঁর ধর্মীয় কুসংস্কারে, এবং ভিয়েনায় তিনি যে-রোগিনীদের চিকিৎসা করতেন, তাদের পারিবারিক-সামাজিক জীবনে। ফ্রয়েড নারীর যে-সব বৈশিষ্ট্যকে জৈবিক, সহজাত ও শাশ্বত ব’লে স্থির করেছিলেন, সেগুলো মূলত বিশেষ সাংস্কৃতিক কারণের পরিণতি। ‘শিশ্নাসূয়া’ বলতে তিনি যা বুঝতেন, তা হচ্ছে পুরুষ-অসূয়া । পুরুষ যে-সব সুযোগসুবিধা ভোগ করে, তাতে পুরুষকে ঈর্ষা করা স্বাভাবিক; কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে নারী ঈর্ষা করে পুরুষের নির্বোধ প্রত্যঙ্গটিকে । রোকেয়া, বাঙলার একমাত্র শুদ্ধ নারীবাদী, নানা রচনায় পুরুষকে আক্রমণ করেছেন, দাবি করেছেন পুরুষের সমান অধিকার । ফ্রয়েড তাকে পেলে সুখী বোধ করতেন; এবং শনাক্ত কবতেন একজন শিশ্নাসূয়াগ্ৰস্ত রোগিণীরূপে! যা বোঝেন নি বৈজ্ঞানিক, তা ঠিকমতো বুঝেছিলেন রোকেয়া (১৯৭৩, ২৯, পাদটীকা) : ‘আমাদের উন্নতির ভাব বুঝাইবার জন্য পুরুষের সমকক্ষতা বলিতেছি। নচেৎ কিসের সহিত এ উন্নতির তুলনা দিব? পুরুষদের অবস্থাই আমাদের উন্নতির আদর্শ।’ ফ্রয়েডের খোজা গূঢ়ৈষা ও শিশ্নাসূয়া ধারণা দুটির উদ্ভব ঘটেছে। এ-বিশ্বাস থেকে যে নারী পুরুষের থেকে জৈবিকভাবে নিকৃষ্ট । তিনি পুরোনো কুসংস্কারকে পরিণত করেছেন আধুনিক অপবিজ্ঞানে। নারীকে ক’রে তুলেছেন নিজেরই শরীরের শিকার। জিহোভার মতো বলেছেন, ‘অ্যানাটমি ইজ হার ডেস্টিনি–শরীরই তার নিয়তি ।’ কুসংস্কার ও বিজ্ঞানের প্রতিভাবান এ-মিশ্রণকারী যে নারীকে বোঝেন নি, তা স্বীকার করেছেন নিজেই; বলেছেন, ‘নারী-আত্মা সম্পর্কে আমার তিরিশ বছরের গবেষণা সত্ত্বেও একটি মহাপ্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি নি; প্রশ্নটি হচ্ছে নারী কী চায়?’
যে-পুরুষতন্ত্র নারীকে সৃষ্টি করেছে, নির্দেশ করেছে প্রতিবন্ধীরূপে, তাকে যে সে কোনো মূল্য দেবে না, বিবেচনা করবে না স্বায়ত্তশাসিত মানুষরূপে, তা অবধারিত। তাই পুরুষ নারীকে সংজ্ঞায়িত করেছে, নারীর অবস্থান নির্দেশ করেছে নিজেকে মানদণ্ড ক’রে। পুরুষ ধ্রুব, নারী আপেক্ষিক। মিশলে বলেছেন, ‘নারী, এক আপেক্ষিক সত্তা।‘ পুরুষের মতে, পুরুষ নারীকে ছাড়াই ভাবতে পারে নিজের কথা; কিন্তু নারী পারে না পুরুষকে ছাড়া নিজেকে ভাবতে। তাই নারী হচ্ছে তা, পুরুষ তাকে যা মনে করে : পুরুষ তাকে মনে করে যৌনসামগ্ৰী। পুরুষের কাছে নারী হচ্ছে যোনি, যৌনবস্তু, কামের পরিতৃপ্তি; এর বেশি নয়, কম নয়। পুরুষ নারীকে নির্দেশ করে, নারীর স্বাতন্ত্র্য বোঝায় নিজের সাথে তুলনা ক’রে । পুরুষ হচ্ছে অনিবাৰ্য, অপরিহার্য, অবধারিত; আর নারী হচ্ছে আকস্মিক, অপ্রয়োজনীয়, সংখ্যাতিরিক্ত [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১৬)]। নারী যে মানুষ, কোনো কিছুর সম্পর্কে না এসেও তার একটি নিজস্ব সত্তা আছে, এটা পুরুষতন্ত্র স্বীকার করে নি। নারীর মূল্য তার মাংসের জন্যে, তার ভূমিকার জন্যে-স্ত্রী, মাতা, দাসী হিশেবে; এর বেশি নয়। সারা এলিস লিখেছেন, ‘তারা (নারীরা) তাদের গঠনে ও পৃথিবীতে তাদের অবস্থান অনুসারে আপেক্ষিক প্রাণী’ [দ্র বাঙ্ক (১৯৭৪, ৫)]। নারীর মাংস চিরকালই পুরুষের কাছে সবচেয়ে সুস্বাদু; বাঙলার রাধা চিৎকার করেছে, ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’; আর বিলেতের রাজকবি টেনিসন পুরুষের সমস্ত ক্ষুধায় উত্তেজিত হয়ে লিখেছেন, ‘পুরুষ শিকারী, নারী শিকার’ [দি প্রিন্সেস, ১৮৪৭]। তাই পুরুষ অন্য যা-কিছু হতে প্ৰস্তুত, শুধু নারী ছাড়া।