ইংরেজি ভাষা নারীপুরুষের দ্বিমেরুত্ব নির্দেশে আরো দক্ষ। ওয়েবস্টারের তৃতীয় নতুন আন্তর্জাতিক অভিধান (১৯৬৬) অনুসারে ‘manly’ হচ্ছে ‘having qualities appropriate to a man : not effeminate or timorous; bold, resolute, open in conduct or bearing’, ‘belonging or appropriate in character to a man’, ‘of undaunted courage: gallant, bold; একই অভিধানে ‘womanly’র অর্থ দেয়া হয়েছে ‘marked by qualities characteristic of a woman’, ‘possessed of the character or behavior befitting a grown woman’, ‘characteristic of, belonging to, or suitable to a woman’s nature and attitudes rather than to a man’s’। র্যানডম হাউজের ইংরেজি ভাষার অভিধানে (১৯৬৭), ‘manly’র অর্থ দেয়া হয়েছে ‘strong, brave, honorable, resolute, virile’ as ‘qualities usually considered desirable in a man’ আর ‘womanly’র অর্থ দেয়া হয়েছে ‘like or befitting a woman; feminine; not masculine or girlsh’, ‘in the manner of, or befitting, a woman’ [দ্র মিলার ও সুইফ্ট্ (১৯৭৬)]। এসব সংজ্ঞায় দেখা যায় পুরুষ বোঝায় মানুষের সব সদগুণ, আর নারী বোঝায় নঞর্থক বৈশিষ্ট্য। তাই পুরুষের সবচেয়ে বেশি অপমান বোধ হয় তাকে লম্পট, চোর, পশু, বদমাশ, গাধা-ধরনের কিছু বললে নয়, তাকে নারী বা মেয়েমানুষ বলা হ’লে।
পুরুষ শুধু নিজেকে নয়, নিজের দেহকেও মনে করে বিশুদ্ধ, উন্নত, আদর্শ কাঠামো; আর নারীদেহকে গণ্য করে বিকৃত, একধরনের প্রতিবন্ধকতা বা কারাগার, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন ‘কুসুমের কারাগার’। ওই দেহের কোনো মাংসকৃত্তি তার কাছে বিশুদ্ধ বৃত্ত, কোনো ত্ৰিভূজ বিশুদ্ধ ত্রিভুজ, কোনো রন্ধ বিশুদ্ধ রন্ধ, কিন্তু তা কামনার সময়ে; উত্তেজনা কেটে যাওয়ার পর ওই দেহকে তার মনেহয় প্ৰতিবন্ধী। আরিস্তাতল বলেছেন, ‘নারী কিছু গুণের অভাব্যবশতই নারী; আমরা মনে করি নারীস্বভাব স্বাভাবিকভাবেই বিকারগ্রস্ত।‘ সন্ত টমাসের মতে, নারী হচ্ছে ‘বিকৃত পুরুষ’, ‘এক আকস্মিক সত্তা’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১৫)]। ইহুদি-খ্রিস্টান-ইসলাম ধর্মে নারীসৃষ্টির যে-উপাখ্যান বলা হয়েছে, তাতে নারীশরীর হয়ে উঠেছে পুরুষশরীরেব একটি ‘অতিরিক্ত অস্থি’র পুনর্বিন্যাস। তাই তার দেহ পুরুষের কামনা জাগালেও শুরু থেকেই নিন্দিত। বাইবেলের আদিপুস্তক-এ নারীসৃষ্টির বিজ্ঞানটুকু এমন : সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে ঘোর নিদ্রায় মগ্ন করিলে তিনি নিদ্রিত হইলেন; আর তিনি তাহার একখান পঞ্জর লইয়া মাংস দ্বারা সেই স্থান পূরাইলেন। সদাপ্ৰভু ঈশ্বর আদম হইতে গৃহীত সেই পঞ্জরে এক স্ত্রী নির্মাণ করিলেন ও তাঁহাকে আদমের নিকটে আনিলেন। তখন আদম কহিলেন, এবার হইয়াছে; ইনি আমার অস্থির অস্থি ও মাংসের মাংস; ইঁহার নাম নারী হইবে, কেননা ইনি নর হইতে গৃহীত হইয়াছেন।‘ নিজের শরীরের জন্যে নারী ঋণী পুরুষের কাছে, আর যে-হাড়ে সে গঠিত ব’লে কথিত, তাও অপরিহার্য, সম্মানজনক নয়। পুরুষ নারীমূর্তি তৈরি করেছে নিজের কল্পনার বক্র হাড়ে, এবং যুগ যুগ ধ’রে তার নিন্দা করছে। একটি হাদিসে আছে : স্ত্রীগণকে সদুপদেশ দাও, কেননা পাঁজরের হাড় দ্বারা তারা সৃষ্ট। পাঁজরের হাড়ের মধ্যে ওপরের হাড় সর্বাপেক্ষা বাঁকা–যদি ওকে সোজা করতে যাও তবে ও ভেঙ্গে যাবে, যদি ছেড়ে দাও তবে আরো বাঁকা হবে।’ [দ্র রফিকউল্লাহ (১৯৭৯, ১৮২)]। প্রতিটি ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমানের চেতনায় নারী হচ্ছে একটি অশীল বক্র হাড়। বলা হয়ে থাকে যে হাওয়া বা ইভ মানবজাতির মাতা, কিন্তু ধর্মগ্রন্থেও–যেহেতু এগুলো পুরুষতন্ত্রেরই অনুশাসন বই–থাকে মারাত্মক স্ববিরোধিতা। ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমানের ধর্মগ্রন্থে হাওয়া বা ইভের আগেই আদমকে তৈবি ক’রে উল্টে দেয়া হয়েছে মানুষজন্মের স্বাভাবিক রীতি; নারীকে জন্ম দেয়া হয়েছে পুরুষের দেহ থেকে, অর্থাৎ পুরুষই হয়ে উঠেছে নারীজাতির মাতা! হাওয়া বা ইভের ধারণাটির উৎপত্তি হয়েছে আদি-বাইবেলেরও আগে, ইহুদিদের প্রাচীন পুরাণে। ইহুদিদের প্রাচীন পুরাণ অনুসারে বিধাতা আদমের জন্যে একটি ‘সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, গৃহকর্মনিপুণা, পতিপরায়ণা, সতীসাধ্বী’ ভাৰ্য্য সৃষ্টির জন্যে তিন-তিনবার উদ্যোগ নেয়; এবং প্রতিবারই কোনো-না-কোনো বিপত্তি ঘটে। আদমের প্রথম ভাৰ্যার নাম লিলিথ, এমন এক করালী নারী যার ওপর আরোহণের সাধ্য নেই কোনো পুরুষের। আদমের সাথে তার একেবারেই মিল হয় নি, কেননা লিলিথ সঙ্গমের সময় আদমের নিচে শুতে রাজি হয় নি। তার যুক্তি ছিলো, সে আর আদম দুজনেই ধুলোয় তৈরি, তাই সমান; সুতরাং সে কেনো আদমের নিচে শোবে? উত্তেজিত আদম তাকে ধর্ষণেব চেষ্টা করলে সে মন্ত্র উচ্চারণ করে হাওয়ায় মিশে যায়। এরপর বিধাতা আদমের দ্বিতীয় ভার্যা (প্রথম হাওয়া) তৈরি করা শুরু করে। কিন্তু আকস্মিকভাবে আদম ওই সৃষ্টিপ্রক্রিয়া দেখে ফেলে, এবং সৃষ্টির দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড ঘেন্না বোধ করে। এতে বিধাতা প্ৰথম হাওয়াকে নিরুদ্দেশ করে ফেলে, এবং আদমের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করে দ্বিতীয় হাওয়াকে যে এখন বিখ্যাত [দ্রা ফিজেস (১৯৭০, ২৭)]। পৃথিবীর তিনটি প্রধান পিতৃতন্ত্রের বদ্ধমূল কুসংস্কার হচ্ছে যে নারী বিকলাঙ্গ, পুরুষের অতিরিক্ত অস্থিতে নির্মিত।