হুমায়ুন আজাদ
নারী, ও তার বিধাতা : পুরুষ
কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে। পুরুষের এক মহৎ প্রতিনিধি, রবীন্দ্রনাথ, বলেছেন, ‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!/পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি।‘ রোম্যানটিকের চোখে নারীমাত্রই দায়িতা বা মানসসুন্দরী, তাই তার চোখে পড়েছে শুধু নারীর চারপাশের বর্ণ, গন্ধ, ভূষণ, যাতে নারীকে সাজিয়েছে পুরুষ। নারীর জন্যে পুরুষসুলভ করুণা, এবং পুরুষ হওয়ার গর্বও তিনি বোধ করেছেন গভীরভাবে। পুরুষ প্রেম আর আলিঙ্গনেও ভুলতে পারে না সে প্ৰভু, নারীর স্রষ্টা। পুরুষের অহমিকা এখানে প্রকাশ পেয়েছে চমৎকারভাবে, নারীসৃষ্টিতে তিনি বিধাতার সাথে পুরুষের ভাগ দাবি করেছেন; এবং অস্বীকার করেছেন নারীর সম্পূর্ণ বাস্তবতাকে ‘অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা’ বলে। তার চোখে নারীর অর্ধেক তো কল্পনা বটেই, আর ওই মানবী টুকুও কল্পনা; অর্থাৎ নারী এক সম্পূর্ণ অবাস্তব সত্তা বা ভাব। তাঁর চোখে নারীর কোনো জৈব অস্তিত্ব নেই। পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা নারী সৃষ্টি না করলেও নারী ধারণাটি পুরোপুরি পুরুষের সৃষ্টি : পুরুষ নারীকে নানা শব্দে শনাক্ত করেছে, নারীর সংজ্ঞা রচনা করেছে, সংজ্ঞার ভাব ব্যাখ্যা করেছে, নারীর অবস্থান নির্দেশ করেছে, নারীর জন্যে বিধি প্রণয়ন করেছে, এবং নিযুক্ত করেছে নিজের কামসঙ্গী ও পরিচারিকার পদে। পুরুষের চোখে নারী বিকৃত মানুষ, অসম্পূর্ণ সৃষ্টি, একরাশ বিকাবের সমষ্টি, এক আপেক্ষিক প্ৰাণী; অর্থাৎ নারীর অস্তিত্ব নিরপেক্ষ স্বায়ত্তশাসিত নয়, নারীকে নির্দেশ করা সম্ভব শুধু কোনো ধ্রুব সত্তার সাথে তুলনা করে। পুরুষ হচ্ছে ওই নিরপেক্ষ ধ্রুব সত্তা। পুরুষ নারীকে মানুষ হিশেবেই স্বীকার করে না। অধিকাংশ ভাষায় ‘মানুষ’ বা ‘মানুষজাতি’ বোঝানোর জন্যে ব্যবহৃত হয় যে-সব শব্দ, সেগুলো ‘পুরুষ’ বোঝায়। ‘ম্যান’ বা ‘ম্যানকাইন্ড’ পুরুষবাচক; আর ‘ওম্যান’ বেশ নিন্দাসূচক। বাঙলায় ‘মানুষ’, ‘লোক’ পুরুষ বোঝায় না বলে মনে হ’তে পারে; কিন্তু ‘মেযেমানুষ’, ‘মেয়েলোক’ বললে বোঝা যায়। আপাতত লিঙ্গবাদী বাঙলা ভাষাও লিঙ্গবাদী, পুরুষতন্ত্রের প্রতাপ এতেও প্ৰচণ্ড। বাঙলায় ‘নারীবাচক’ সমস্ত শব্দই কদৰ্থক, বা নির্দেশ করে কামশোষণ। নারী, স্ত্রী, রমণী, ললনা, অঙ্গনা, কামিনী, বনিতা, মহিলা, বামা, নিতস্বিনী, সুন্দরী প্রভৃতি শব্দে কামঙ্গুধার দাগ স্পষ্ট ৷ ‘মেয়েমানুষ’, ‘মেয়েলোক’, ‘মেয়েছেলে’ বললে বোঝায় একটি স্ত্রীলিঙ্গ পশু। পুরুষতন্ত্র নারীর যে-ভাবমূর্তি তৈরি করেছে কয়েক সহস্রকের সাধনায়, তাতে ‘নারী’ বললে মানুষ বোঝায় না; বোঝায় একধরনের মানুষ, যা বিকৃত, বিকলাঙ্গ, অতিরিক্ত, বা না-পুরুষ।
নারী কাকে বলে? দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ৩৫) বলেছেন, এর উত্তরে একধরনের পুরুষ বলে, ‘নারী হচ্ছে জরায়ু, ডিম্বকোষ; নারী হচ্ছে স্ত্রীলোক।‘ পুরুষ এমন অসংখ্য সংজ্ঞা দেয় নারীর, যার সবটাই নিন্দাসূচক। কোনো কোনো নারীকে দেখিয়ে তারা বলে, সে নারী নয় যদিও তার জরায়ু-স্তন-যোনি সবই রয়েছে। ওই নারীর মধ্যে তারা দেখতে পায় নারীত্বের অভাব, চিরন্তন নারীত্বের উনতা। তারা চায় নারী হবে নারী, থাকবে নারী, আর হয়ে উঠবে নারী। পুরুষ চায় শাশ্বতী নারী, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। চিরন্তনী বা শাশ্বতী হচ্ছে পুরুষের এক চিরকালীন চক্রান্ত বা ক্ষুধা। সুধীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সামান্যাদের সোহাগ খরিদ ক’রে/চিরন্তনীর অভাব মেটাতে হবে’, তবে কোটি মন্বন্তরেও তিনি ভুলতে পারবেন না শাশ্বতীকে; পুরুষের কামনার সাথে না মিললে নারীমাত্রই পুরুষের কাছে সামান্যা : জরায়ু-যোনি-স্তনের সমষ্টি, নিজের লিঙ্গে ও যৌনতায় বন্দী পশু। পুরুষ ও স্ত্রী বা নর ও নারী ব্যাকরণে দুটি সুষম রূপ বোঝালেও জীবনে বোঝায় দুটি ভিন্ন মেরু। পুরুষ ও নারী নির্দেশ করে দ্বিমুখি বৈপরীত্য : পুরুষ বোঝায় সমস্ত সদর্থক বা অস্তিবাচক গুণ, আর নারী বোঝায় কদৰ্থক বা নঞর্থক বৈশিষ্ট্য। পুরুষ বোঝায় স্বাভাবিকত্ব, আদর্শ রূপ; নারী বোঝায় অস্বাভাবিকত্ব, বিকৃত রূপ। এলেন সিজো পুরুষ-নারীর দ্বিমুখি বৈপরীত্যের একটি তালিকা রচনা করেছেন, যাতে ধরা পড়েছে পুরুষ-নারী সম্পর্কে পিতৃতান্ত্রিক দ্বিমুখি চিন্তাধারা। তালিকাটি নিম্নরূপ [দ্র মোই (১৯৮৫, ১০৪)] :
পুরুষ — নারী
সক্রিয় : অক্রিয়
সূৰ্য : চন্দ্র
সংস্কৃতি : প্রকৃতি
দিন : রাত্রি
পিতা : মাতা
বুদ্ধি : আবেগ
বোধগম্য : দুবোধ্য, স্পর্শকাতর
বিশ্বনিয়ন্ত্ৰক : করুণ
এ-তালিকার দ্বিমুখি বৈশিষ্ট্যে ধরা পড়েছে পুরুষতন্ত্রের মূল্যবোধ। ওই বোধে পুরুষ সব সময় নির্দেশ করে মানুষের সদগুণগুলো, আর নারী নির্দেশ করে নঞর্থকগুলো। তালিকাটি আরো বাড়ানো যেতে পারে, এবং তাতেও দেখা যাবে পুরুষতন্ত্র যাকে ভালো মনে করে, অনেক সময়ই খামখেয়ালিভাবে, তাই হচ্ছে পুরুষের গুণ; আর যা কিছুকে ভালো মনে করে না, তাই নারীর বৈশিষ্ট্য। ‘পৌরুষ’ হচ্ছে মহাজাগতিক সদগুণের সমষ্টি, এর বিপরীত নারীত্ব হচ্ছে অনন্ত নঞর্থকতা। যে-কোনো সাধারণ অভিধানে, যে-কোনো ভাষায়, ‘পুরুষ’, ‘নারী’ বা ‘স্ত্রী’ অন্তর্ভুক্তিগুলো দেখলে বোঝা যায় পুরুষ কতো স্বর্গীয় আর নারী কতো নারকীয়। ‘পুরুষ’ হচ্ছে ‘নর, মনুষ্য, আত্মা, ঈশ্বর, পরমব্ৰহ্ম’, ‘পুরুষত্ব’ হচ্ছে ‘পৌরুষ, উদ্যম, তেজ, পুরুষের রতিশক্তি’। ‘নারী’ হচ্ছে ‘রমণী, স্ত্রীলোক, পত্নী’, ‘নারীধর্ম’ হচ্ছে ‘সতীত্ব মমতা বাৎসল্য প্রভৃতি নারীসুলভ গুণ’; ‘স্ত্রী’ হচ্ছে ‘পত্নী, জায়া, নারী, রমণী, বামা, কামিনী’, ‘স্ত্রীচরিত্র’ হচ্ছে ‘নারীজাতির প্রকৃতি বা স্বভাব’; ‘স্ত্রীধর্ম’ হচ্ছে ‘রজঃ, ঋতু, স্ত্রীলোকের কর্তব্য’ [দ্র শৈলেন্দ্র (১৯৬৪)]।