পুরুষতন্ত্র নারীকে নিয়োগ করেছে একরাশ ভূমিকায় বা দায়িত্বে। নারীকে নিয়োগ করেছে কন্যা, মাতা, গৃহিণীর ভূমিকায়; এবং তাকে দেখতে চায় সুকন্যা, সুমাতা, সুগৃহিণীরূপে। কোনো নিম্নপদকে অসার মহিমা দিতে হ’লে পদগুলোকে সুভাষিত করতে হয়; পুরুষতন্ত্ৰও নারীর ভূমিকাগুলোকে সুভাষিত করেছে, সেগুলোর সাথে জড়িয়ে দিয়েছে বড়ো বড়ো ভাব। তবে ওই ভূমিকাগুলোর গৃঢ় তাৎপর্য একটি শব্দেই প্রকাশ পায় : শব্দটি দাসী। এ-অঞ্চলে দেবী শব্দটি দাসীরই সুভাষণ। পুরুষতন্ত্র শুধু বলপ্রয়োগ ক’রে অধীনে রাখতে চায় নি নারীকে, তাকে স্তবস্তৃতিও পান করিয়েছে। পুরুষ কখনো মনে করে নি যে তার জীবনের সার্থকতা পুত্র, পিতা, গৃহস্থ হওয়াতেই; বরং এ-ভূমিকাগুলো পেরিয়ে যাওয়াকেই মনে করেছে পৌরুষ; কিন্তু নারীর সার্থকতা নির্দেশ করেছে কয়েকটি তুচ্ছ ভূমিকা পালনে। পুরুষ নারীকে গৃহে বন্দী করেছে, তাকে সতীত্ব শিখিয়েছে, সতীত্বকে নারীর জীবনের মুকুট করে তুলেছে, যদিও লাম্পট্যকেই ক’রে তুলেছে নিজের গৌরব। পুরুষ উদ্ভাবন করেছে নারী সম্পর্কে একটি বড়ো মিথ্যা, যাকে সে বলেছে চিরন্তনী নারী। তাকে বলেছে দেবী, শাশ্বতী, কল্যাণী, গৃহলক্ষ্মী, অর্ধেক কল্পনা; কিন্তু পুরুষ চেয়েছে ‘চিরন্তনী দাসী’। পশ্চিমে নারীরা শোষিত, তবে মানুষ-পুরুষ দ্বারা শোষিত; আমাদের অঞ্চলে নারীরা শোষিত পশু-পুরুষ দ্বারা। এখানে পুরুষেরা পশুরই গোত্রীয়, তাই বঙ্গীয়, ভারতীয়, আর পূর্বাঞ্চলীয় নারীরা যে-শোষণপীড়নের শিকার হয়েছে, পশ্চিমের নারীরা তা কল্পনাও করতে পারবে না। বাঙলায় নারীরা এখনো পশুদের দাসী। পশ্চিমে নারীমুক্তির যে-আন্দোলন চলছে, তার ঢেউ এখানে এসে এখনো ভালোভাবে লাগে নি। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে বাঙলায় নারীদের শিক্ষার যে-ধারা শুরু হয়, তার উদ্দেশ্য নারীকে স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত করা নয়, তার লক্ষ্য উন্নতজাতের স্ত্রী বা শয্যাসঙ্গিনী উৎপাদন। নারীশিক্ষাও প্ৰভু পুরুষেরই স্বার্থে। বিবাহ এখানে নারীদের পেশা। বাঙলাদেশে যারা নারীদের কল্যাণ চান, তারা মনে করেন নারীর কল্যাণ শুভবিবাহে, সুখী গৃহে; স্বামীর একটি মাংসল পুতুল হওয়াকেই তারা মনে করেন নারীজীবনের সার্থকতা। স্বামী যদি ভাতকাপড় দেয়, তার ওপর দেয় লিপষ্টিক নখপালিশ ইত্যাদি, এবং আর বিয়ে না করে, করলেও অনুমতি নিয়ে করে, বা তালাক না দিয়ে চার স্ত্রীকেই দেখে ‘সমান চোখে’, তাহলেই নারীকল্যাণপিপাসুরা পরিতৃপ্ত, ও তাদের আন্দোলন সফল ভেবে ধন্য বোধ করেন। তাঁরা আসলে পুরুষতন্ত্রের শিকার; তারা নারীকে দেখতে চান সচ্ছল দাসীরূপে। নারীর জন্যে এর চেয়ে ক্ষতিকর আর কিছু হ’তে পারে না। তারা মানুষ হিশেবে নারীর অধিকার আদায্যের আন্দোলন করেন না, তাদের আন্দোলন হচ্ছে স্বামীতন্ত্রের কাছে স্ত্রীতন্ত্রের আবেদননিবেদন। বিয়ে, স্বামী, সন্তান, গৃহ, সুখ, প্ৰেম মধুর বাজে কথা; এগুলোতে নারীর মুক্তি নেই, এগুলোতেই বন্দী নারী। পশ্চিমের নারীবাদীরা প্রত্যাখ্যান করেছে এসব। নারীবাদীরা পশ্চিমের পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতাকে দিয়েছে একটা বড়ো নাড়া, ও বদলে দিয়েছে অনেকটা, যদিও তাদের চূড়ান্ত সাফল্য আজো সুদূরে। পুরুষতন্ত্রের মতো কয়েক হাজার বছরের একটি বড়ো রকমের চক্রান্তকে, পীড়ন যন্ত্রকে, দু-চার দশকে, বা দু-এক শতকে নিক্রিয় ক’রে দেয়া অসম্ভব।
পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার বয়স কয়েক সহস্ৰক; কিন্তু পৃথিবী ও মানবপ্রজাতি, যদি কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, টিকে থাকবে আরো কয়েক কোটি বছর। তাই পুরুষতন্ত্রই শাশ্বত ও সভ্যতার ভবিষ্যৎ, এটা ভাবার কারণ নেই। বাঙলাদেশের এক অবরুদ্ধ সুলতানা নারীস্থানের বা নারী তন্ত্রের যে-স্বপ্ন দেখেছিলো, তা যে ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হবে না, বা নারীপুরুষের সাম্যভিত্তিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে না, এমন ধারণা অযৌক্তিক। পশ্চিমের নারীবাদীরা গত চার দশকে, সিমোন দ্য বোভোয়ার-এর দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর (১৯৪৯) প্রকাশকাল থেকে, নারীবিষয়ক যে-সব গ্রন্থ লিখেছেন, সেগুলোর অসাধারণত্ব স্বীকার না করে উপায় নেই। তাদের ব্যাখ্যা, ভাষ্য, প্ৰস্তাব মেধাপ্রতিভা, ও সাহসের উজ্জ্বল উদাহরণ। নারী সম্পর্কে তাদের মূল বক্তব্য এখনো আমাদের এখানে এসে পৌঁছে নি; বা মধ্যযুগের অধিবাসী আমরা এখনো এতোটা সাহসী হতে পারি নি যে তাদের বক্তব্য নিৰ্ভয়ে পেশ করবো। পুরুষতন্ত্রের নানা রকম পুলিশ এখানে নানাভাবে সক্রিয়। নারীবাদের ঠিক সংবাদ আমরা পাই নি, তবে বিকৃত সংবাদ পেয়েছি অনেক; এবং এখানকার পুরুষতন্ত্র একথা প্রচার করতে সফল হয়েছে যে নারীবাদ হচ্ছে বিকার। নারী-অধিকারবাদীরাও এখানে নারীবাদের কথা শুনলে ভয় পান, নিজেদের নারীবাদী বলতে নববধুর মতো লজ্জা বোধ করেন। তাদের কাছে নারীবাদী এক কামুক নারী, যার কাজ পুরুষ থেকে পুরুষে ছোটা। এটা সত্যের চরম অপলাপ, নারীবাদের বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্রের অশ্লীল অপপ্রচার। যিনি নারীপুরুষের সাম্যে ও সমান অধিকারে বিশ্বাস করেন, তিনিই নারীবাদী। আমাদের নারী-অধিকারবাদীরা নারীর অধিকারের চেয়ে স্ত্রীর অধিকার নিয়েই বেশি ব্যস্ত, তাঁরা স্ত্রীবাদী বা ভদ্রমহিলাবাদী। আমাদের অঞ্চলের দুটি গোত্র–হিন্দু ও মুসলমান–পুরুষতন্ত্রের প্রচণ্ড পুরোধা। পশ্চিমের নারীবাদীরা খুব ভদ্র মহিলা নন, তিরষ্কারকে আর তারা পুরুষতন্ত্রের একচেটে সম্পত্তি বলে মনে করেন না; তাই তাঁরা নিয়মিতভাবে তিরষ্কার করেন পুরুষদের। এক জাতের পুরুষদের তাঁরা বলেন মেল শভিনিষ্ট পিগ বা আত্মম্ভরী পুংশুয়োর বা পুংগর্বী শুয়োর, আমাদের অঞ্চলে সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থ, ধর্মীয় কারণে পুংগর্বীদেরই প্রাধান্য। তাই নারীবাদ যে এখানে নারীর মতোই নিষিদ্ধ থাকবে, এটা স্বাভাবিক । আমি এ-বইতে প্ৰকাশ করতে চেয়েছি নারীবাদীদের মূল বক্তব্য ও প্রস্তাবগুলো; বাঙলা ভাষা ও বাঙলাদেশের নারীদের পরিচয় থাকা দরকার এর সাথে।