রোমান আইনে ইংরেজি সাধারণ আইনের থেকে পিতৃতান্ত্রিক হিংস্ৰতা আরো প্রচণ্ড। ইংরেজি আইনে অবিবাহিত নারীদের কিছু অধিকার আছে, কিন্তু রোমান আইনে কোনো অধিকার নেই অবিবাহিতাদেরও। তাদের চিরকাল বাস করতে হয়, কোনো রোমান মনুর বিধানেই যেনো, কোনো পুরুষ অভিভাবকের অধীনে। রোমান আইন কোনো অবস্থায়ই নারীকে স্বাধীনতার যোগ্য মনে করে না। নেপোলিয়ন রোমান আইনকে মান-ও বিধি-বদ্ধ করে গ্রহণ করে তার সাম্রাজ্যের আইনরূপে। এর নতুন নাম হয় নেপোলিয়নি বিধি [কোড নেপোলিয়ন]। একনায়কের বিধিবদ্ধ আইনে চরমভাবে প্ৰকাশ পায় একনায়কের স্বৈরাচার। নেপোলিয়নের কাছে নারী এমন একটি রাজ্য, যাকে শুধু জয় করলেই চলবে না, তাকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত পর্যুদস্ত পদদলিত করতে হবে। তার বিধি নারীকে তাই করে; এ-বিধিতে নারী হয়ে ওঠে সবচেয়ে লণ্ডভণ্ড রাজ্য। নারী সম্পর্কে তার ধারণা খ্রিস্টান সন্তদেরই মতো। এ-একনায়ক বলেছে, ‘প্রকৃতি চেয়েছে যে নারী হবে আমাদের দাসী। তারা আমাদের সম্পত্তি, আমরা তাদের সম্পত্তি নই। ফলবান গাছের মালিক যেমন মালি, আমরাও তেমনি তাদের মালিক। নারীর সমানাধিকার দাবি নিছক পাগলামো! নারী সন্তান উৎপাদনের কল ছাড়া আর কিছু নয়’ [দ্র নিউল্যান্ড (১৯৭৯, ১৩)]। এ-বিধি পশ্চিম ইউরোপে ও ফরাশি উপনিবেশে চাপিয়ে দেয়া হয়, এবং হঠাৎ অনেক দেশে নারী নিজেকে দেখতে পায় গৃহদাসীরূপে। এ-আইনেও নারী শিশু আর নির্বোধদের শ্রেণীভুক্ত; তাই তারা কোনো চুক্তি করতে পারে না, স্বামীর স্বাক্ষর ছাড়া স্বাধীনভাবে আইনসম্মত লেনদেন করতে পারে না, বাকিতে কিছু কিনতে পারে না, ব্যাংকে একটি হিশেবেও খুলতে পারে না। এ-আইনে স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তির এবং জীবনের পরিচালক। স্ত্রী যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায় বা চাকুরি করতে চায, তাহলেও স্বামীর অনুমতি নিতে হয়। এ-আইনে স্বামীর প্রতি আনুগত্য শুধু সামাজিক বা ধর্ময়ি নয়, তা আইনগত।
এখন উগ্রতম পিতৃতন্ত্র মুসলমান পিতৃতন্ত্র, এর বিকাশ ঘটেছে কম। ইসলাম কনিষ্ঠ ধর্ম, এটি যে-অঞ্চলে বিকশিত হয়েছে সে-অঞ্চলের দুটি পুরোনো ধর্মের উত্তরাধিকার বহন করে অনেকখানি; এ-ধর্ম নারীকে দিয়েছে কিছু অধিকার, যা আগের পিতৃতন্ত্রগুলো দেয় নি। তবে মুসলমান দেশগুলোতেই নারী এখন সবচেযে শৃঙ্খলিত, কেননা অন্যান্য পিতৃতন্ত্রগুলোর বিবর্তন ঘটেছ, আর এটি বিবর্তন রোধ ক’রে চলছে। এখন অনেক দেশে এর অবলম্বনকারীদের সহনশীলতাও এতো কম যে এর সম্পর্কে নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ কিছু লেখাও বিপজ্জনক। প্রচারের ফলে মুসলমানদের মধ্যে জন্মেছে এমন এক বদ্ধমূল ধারণা যে ইসলামপূর্ব আরবে নারীদের অবস্থা ছিলো শোচনীয়; ইসলাম উদ্ধার করে তাদের। প্রতিটি ব্যবস্থা পূর্ববতী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়; তবে তা ঐতিহাসিকভাবে সাধারণত সত্য হয় না। আরব নারীদের নানা ইতিহাস লেখা হয়েছে; সবগুলোতেই স্বীকার করা হয় যে ইসলামপূর্ব আরবে অনেক বেশি ছিলো নারীদের স্বাধীনতা ও অধিকার। তারা অবরোধে থাকতো না, অংশ নিতো সমস্ত সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডে: এমনকি তাদের প্রাধান্য ছিলো সমাজে। শিশুকন্যা হত্যার জন্যে আরবরা খুব নিন্দিত ইতিহাসে, কিন্তু তারা সব শিশুকন্যা হত্যা করতো না, করলে জাতিটিই লুপ্ত হয়ে যেতো। শিশুকন্যা হত্যা একান্ত আরবি রীতি ছিলো না, পৃথিবীর নানাদেশে, যেমন ভারতেও, ছিলো। এ-ধর্ম শিশুকন্যাদের বঁচিয়েছে, তবে নারীদের মুক্ত সমাজ থেকে স্থানান্তরিত করেছে অবরোধে [দ্ৰ সোহা আবদেল কাদের (১৯৮৪, ১৪০)]।
কোরান-এ আছে :
হে নবীপত্নীগণ,… তোমাবা নিজেব গৃহে থাকবে; প্রাচীন যুগের মতো নিজেদেব প্রদর্শন ক’রে বেড়িও না [আহজাব : ৩২.৩৩]।
বোখারিতে [দ্র নূর মোহাম্মদ (১৯৮৭, ১৯৬)] আছে :
বিবি আয়েশা (রাঃ) বলিয়াছেন : নারীগণ এখন যে ধরনের চালচলন এখতেয়ার করিয়াছে তাহা যদি রছুলুল্লাহ (ছঃ) দেখিতেন, তবে নিশ্চয় তাহাদিগকে মসজিদে যাইতে বাধা দিতেন।
এ থেকে বোঝা যায় ইসলামের আগে ও প্রথম পর্যায়ে নারীদের যে-অধিকার ও স্বাধীনতা ছিলো, তা পরে হরণ করা হয়। ফাতনা এ সাবাহ [ফাতিমা মেরনিস্সির ছদ্মনাম] নামক এক নারী ও মুসলমান ঐতিহাসিক মুসলমানের অবচেতনায় নারী (১৯৮৪) গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ইসলামে নারী হচ্ছে বিকলাঙ্গ প্ৰাণী’; তিনি আরো লিখেছেন, ‘যতোবারই আমি সেই ক্লান্তিকর ভণিতাটি শুনি যে সপ্তম শতাব্দী থেকে ইসলাম নারীকে দিয়েছে উচ্চ স্থান, ততোবারই আমি বিবমিষা বোধ করি’ [দ্র মাইলস (১৯৮৮, ৭৫)]। নারীকে ইসলাম কতোটা অধিকার দিয়েছে বা দিতে পারে, তা বোঝার জন্যে নারী সম্পর্কে ইসলামি ধারণার সাথে কিছুটা পরিচয় থাকা দরকার।
ইসলামি শাস্ত্ৰে নারী ও কাম সম্পর্কে ধারণার পরিচয় দিয়েছেন ফাতিমা মেরনিস্সি তাঁর ‘বোরখা পেরিয়ে’ (১৯৭৫) গ্রন্থে। তিনি দেখিয়েছেন, ইসলামে কামকে দেখা হয় এক আদিম শক্তিরূপে, যা শুভও নয় অশুভও নয়। তার শুভাশুভ নির্ভর করে ব্যবহারের ওপর। ইসলামে মনে করা হয় যে নারীপুরুষের মধ্যে নারীর কামই প্রচণ্ড, তাই তা দারুণ সামাজিক উদ্বেগের ব্যাপার। নারীর ওই কামকে যদি বশে রাখা না হয়, তবে তা সৃষ্টি করবে ফিৎনা বা সামাজিক বিশৃঙ্খলা, যা নষ্ট করে দেবে সমাজকে। ইসলাম মনে করে নারীর পক্ষে নিজের কামকে বশে রাখা সম্ভব নয়, কেননা নারীর সে-চারিত্রিক শক্তি নেই; কিন্তু পুরুষের আছে, কেননা পুরুষ শারীরিক, মানসিক ও নৈতিকভাবে নারীর থেকে উৎকৃষ্ট। তাই স্বাভাবিকভাবেই পুরুষ পেয়েছে নারীর ওপর প্রভুত্বের ও নারীকে রক্ষার অধিকার। নারীকে যে বোরখায় মুড়ে বা অবরোধে আটকে রাখা হয়, তা সমাজকে নারীর অনিবার কামের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচানোর জন্যে [দ্র আমল রাসসম (১৯৮৪, ১২৯)]। পুরুষ সম্পর্কে উচ্চ ও নারী সম্পর্কে নিম্ন ধারণা ইসলাম পেয়েছে ইহুদি-খ্রিস্টান ঐতিহ্য থেকে; এবং তাকে বদ্ধমূল ক’রে তুলেছে। পুরুষকে যে-চারিত্রিক শক্তির অধিকারী ব’লে মনে করা হয়, তা আসলে পুরুষের নেই; আর নারীর মধ্যে চারিত্রিক শক্তির যে-অভাব রয়েছে ব’লে মনে করা হয়, তাও ভুল। কামের বেলা তা অত্যন্ত স্পষ্ট : নারীর কামসংযমের পাশে পুরুষ কামইতর প্রাণী। ইসলামে নারী সম্পর্কে রয়েছে যে-অবিশ্বাস, তা বিশেষভাবেই আরববিশ্বাস; আরবরা সম্ভোগ্যপরায়ণ, তারা নারী থেকে নারীতে ছোটে, কিন্তু কলঙ্ক দেয় নারীদের। আরব্য রজনীর উপাখ্যানগুলোতে রয়েছে এর বিশ্বস্ত পরিচয় ; উপাখ্যানগুলোতে পুরুষেরা সম্ভোগে অক্লান্ত, কিন্তু অসতী অবিশ্বাসিনীর অপবাদ বইতে হয়েছে নারীদের। আরব্য রজনীর কবি পুরুষদের শিখিয়েছেন [দ্র ক্ষিতীশ (১৯৮২, ১০)] :