ইংরেজি সাধারণ আইন ও রোমান আইনে প্রকাশ পেয়েছে পিতৃতন্ত্রের এ-মনোভাবই; এ-দু-আইনেই নারী পুরুষের সম্পূর্ণ অধীন। নারীকে পুরুষের বাধ্যতামূলক ক্রীতদাসী করার একটি নিপুণ কৌশলের নাম হচ্ছে বিবাহ, যার কবলে পড়ে নারী হারায় তার অস্তিত্ব ও অধিকার। ইংরেজি সাধারণ আইনে স্ত্রীকে স্বামীর রক্ষণাবেক্ষণে থাকতে হ’লে পালন করতে হয় কতকগুলো শর্ত [কোভেরচার], যেগুলোর কাজ হচ্ছে নারীকে অস্তিত্বহীন করা। এ-শর্তের উৎস বাইবেলের একটি অনুশাসন : ‘মনুষ্য আপন পিতামাতাকে ত্যাগ করিয়া আপন স্ত্রীতে আসক্ত হইবে, এবং তাহারা একাঙ্গ হইবে’ [আদিপুস্তক, ২.২৪] ; শুনতে সুখকর শোনালেও আইনে এর তাৎপর্য হচ্ছে স্ত্রীর ‘ব্যবহারিক মৃত্যু’। আইনের ভাষায় এ-অনুশাসন বোঝায় স্বামী-স্ত্রী এক ব্যক্তি; অর্থাৎ স্ত্রীর কোনো ভিন্ন সত্তা নেই। ধর্মের এক কথায় স্বামীর শরীরে বিলীন হয়ে গেছে স্ত্রীর সমগ্র অস্তিত্ব। বিচারক ব্ল্যাকস্টোন এর আইনগত ব্যাখ্যা দিয়েছেন : ‘আইনে, বিয়ের ফলে, স্বামী ও স্ত্রী অভিন্ন ব্যক্তি : অর্থাৎ বিবাহিত অবস্থায় নারীর সত্তা বা আইনগত অস্তিত্ব বাতিল, বা অন্তত নারীর অস্তিত্ব স্বামীর অস্তিত্ত্বে গৃহীত ও সংহত’ [ দ্র মিলেট (১৯৬৯, ৬৮)]; রিস বলেছেন, ‘আইনে নারী তার বিবাহিত পুরুষের সম্পত্তি; সে তার অস্থাবর মাল’; এলিজা কুক লিখেছেন, ‘স্বামী স্ত্রীর, স্ত্রীর সম্পত্তির, ও স্ত্রীর সন্তানের নিরঙ্কুশ প্রভু’ [দ্র বাস্ক (১৯৭৪, ১৭)]। হিন্দুবিধানেও স্ত্রীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় স্বামীর অস্তিত্বের মহাসমুদ্রে [মনুসংহিতা, ৯:২২]৷ স্বামী-স্ত্রীর একদেহে বিলীন হওয়া কাম ও কাব্যিকভাবে চমৎকার, কিন্তু আইনের দিকে ভয়াবহ। এতে স্বামীর শরীর বা অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় না, বিলুপ্ত হয় নারীর শরীর ও অস্তিত্ব; এ-বিলুপ্তির মূল্য দিতে হয় নারীকে তার মাত্র একটি সামান্য জীবন দিয়ে। স্বামী হয় প্রভু, স্ত্রী ভূমিদাসী। বিয়ের অনুষ্ঠানেই বধুটিকে দীক্ষা দেয়া হয় সন্ত পলের অনুশাসনে : ঈশ্বরের প্রতি সে যেমন অনুগত থাকবে তেমনই অনুগত থাকবে স্বামীর প্রতি।
ইংরেজি সাধারণ আইনে স্ত্রীকে ফেলা হয় শিশু, নির্বোধ ও বদ্ধপাগলের দিলে, যে অক্ষম নিজের দায়িত্ব নিতে; যার নেই কোনো বিবেচনাশক্তি। অস্তিত্বলোপের অর্থ খুবই ভীতিকর; এতে স্বামীকে দেয়া হয় স্ত্রীর শরীরের সম্পূর্ণ মালিকানা, স্বামী ওই সম্পত্তি ভোগ করতে পারে যথেচ্ছভাবে। বেকন এ-মালিকানার মানে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে : ‘স্বামী পিটোতে পারে স্ত্রীকে, তবে খুব ভয়ঙ্কর বা নিষ্ঠুরভাবে নয়; দরকার মনে করলে স্বামী স্ত্রীকে আটকে রাখতে পারে, তবে সে স্ত্রীকে কারারুদ্ধ করে রাখতে পারে না।’ [দ্র বাঙ্ক (১৯৭৪, ১৭)]। অস্তিত্বলীনের মানে হচ্ছে স্বামী বা কারো বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়ার কোনো অধিকার তার নেই; সে কারো সাথে কোনো চুক্তি সম্পাদনের অধিকারী নয়; ঋণ আদায়ের জন্যে সে মামলা করতে পারে না; কারো বিরুদ্ধে সে পারে না মানহানির অভিযোগ আনতে, এবং তার বিরুদ্ধেও পারে না কেউ। অর্থাৎ বিয়েতে বাতিল হয়ে যায় তার নাগরিক অধিকার, আইনের চোখে সে নিরস্তিত্ব। তার হাতপা বাধা: তার অস্তিত্ব নেই, গৃহ নেই, সহায় নেই, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নেই। সে নিজেই তো নেই : বিয়ে হচ্ছে নারীর অস্তিত্বহীনতা–কিছুদিনও আগেও ইংরেজি সাধারণ আইনে বিয়ে ছিলো এতোই মধুর ও মর্মান্তিক। বিয়েতে নারীর অস্তিত্বলীনের ব্যাপারটি মোটেই আধ্যাত্মিক নয়, সম্পূৰ্ণ বৈষয়িক; ওই আইনে বিয়ের পর নারীর নিজের অধিকারে কিছুই থাকে না। সে নিজের মালিক নয়, সে নিজের আঁকাবাঁকা দেহখানির মালিক নয়, সে মালিক নয় কিছুরই। যে কোনো কিছুর মালিক হতে পারে না, তার আবার কিসের অস্তিত্বস্বাতন্ত্র্য? একই কারণে হিন্দুবিধানেও বারবার বলা হয়েছে ‘ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যামর্হত’ [মনুসংহিতা, ৯:৩]।
স্বামী-স্ত্রীর একাঙ্গ হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে বিয়ের পর স্ত্রীর সমস্ত সম্পত্তির, এমনকি তার নিজের, মালিক হয় স্বামী। এর বিনিময়ে স্বামী তার রক্ষণাবেক্ষণ করে, তার ভরণপোষণ করে। বিয়ের সময় নারীর যা-কিছু স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি থাকে, তা হয়ে ওঠে স্বামীর সম্পত্তি, আর স্ত্রী হয়। স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তি! এমনকি বিয়ের পরও সে যা কিছুর মালিক হয়, তাও তার থাকে না, অবলীলায় হয়ে ওঠে। স্বামীর। স্বামীর এ-অধিকার শুধু বিবাহিত কালের নয়, ১৮৫৭র আগে বিবাহবিচ্ছেদের পরও স্বামী ভোগ করতো স্ত্রীর ওপর এ-অধিকার। ১৮৩৭-এর আগে সন্তানের ওপরও নারীর ছিলো না অধিকার, সব অধিকার ছিলো স্বামীর। আইন, পিতৃতান্ত্রিক রীতিতে, মাকে স্বীকারই করতো না; স্বীকার করতে শুধু পিতাকে। পিতার জীবনকালে মায়ের কোনো অধিকার ছিলো না; তার প্রাপ্য ছিলো। শুধু ‘সম্মান’, আর তখন একেই মনে করা হুতো নারীর গৌরব। পিতা সন্তানদের শাস্তি দিতে পারতো, মায়ের কাছে থেকে কেড়ে নিতে পারতো, নিজের রক্ষিতার কাছে রাখতে পারতো; এবং মাকে নিষিদ্ধ করে দিতে পারতো। কুমারী অবস্থায় তার বেশ কিছু অধিকার ছিলো, কিন্তু একাঙ্গ হওয়ার পর সে হারায় সব কিছু। ইংরেজি আইন ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিধি; তাই এ-আইন ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা পৃথিবীতে। এ-আইন কোনো কোনো দেশে নারীকে প্রথাগত নিষ্ঠুরতর আইনের কবল থেকে কিছুটা উদ্ধার করে, যেমন ভারতে; আবার কোনো কোনো দেশে এ-আইন নারীর বহুদিনের অধিকার হরণ করে, যেমন ব্ৰহ্মদেশে। ব্ৰহ্মদেশে স্বামীস্ত্রীকে পরস্পরের প্রতি পালন করতে হতো ‘পাঁচটি আনুগত্য’, কিন্তু এ-আইন স্বামীর আনুগত্য লোপ ক’রে স্ত্রীকে করে স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তি ও দাসী।