রামমোহন ও বেন্টিংক হিন্দু বিধবাকে প্ৰাণ দিয়েছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর [১৮২০–১৮৯১] দেয়ার চেষ্টা করেন জীবন। সব বিধবা সহমরণে যেতো না, তবে যারা বেঁচে থাকতো তারা বাঁচতো চরম লাঞ্ছনা, অপমান, কলঙ্কের মধ্যে। বিদ্যাসাগর বিধবাদের বিয়ে দেয়ার আন্দোলন শুরু করেন; অশ্লীল রক্ষণশীলেরা প্রথমে সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে, পরে মেতে ওঠে বিধবার যোনির ক্ষতাক্ষত বিচারে; তবে ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়। বিদ্যাসাগর কিছু বিধবাকে বিয়েও দেন; তবু আজো হিন্দুসমাজ বিধবার বিয়ে মেনে নেয় নি। বিধবার বিয়ের কথা ভাবতে এখনো হিন্দুসমাজের রক্ত জমে বরফ হয়ে যায়; এমনকি নারীরাও বিধবা বিয়ের কথা শুনলে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম করে। সতীদাহ বন্ধ হয়েছে, কেননা প্রকাশ্য নৃশংসতা বন্ধ করা সহজ; বিধবার এখনো বিয়ে হয় না, কেননা গোপন নৃশংসতা বন্ধ করা কঠিন। বিধবাকে বোঝার মতো সংবেদনশীলতা বা মনুষ্যত্ব হিন্দুসমাজ আজো আয়ত্ত করে নি। অধিকাংশ হিন্দু বিধবার জীবনে দুৰ্গতির শেষ নেই; শ্বশুর বা পিতার পরিবারে তারা যাপন করে লাঞ্ছিত জীবন। তাদের যে-ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে পুরুষতন্ত্র, তা পতিতার; যেনো হিন্দু বিধবা কাম ক্ষুধার্তা নারী, যার দিবসরজনী কাটে নিরন্তর কামযন্ত্রণায়, পুরুষ পেলেই যে লিপ্ত হয় রতিক্রিয়ায়। বালবিধবাদের শারীরিক জ্বালার কথা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু তারা পুরুষখেকো ডাইনি নয়, পুরুষেরাই বিধবাখের দানব। কোনো পাড়ায় একটি তরুণী বিধবা থাকলে ওই এলাকার সব পুরুষের কাম তাকে ঘিরে জ্বলতে থাকে; এক সময় তা পোড়ায় বিধবাটিকে। বিদ্যাসাগর ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’-এ (১৮৫৫) লিখেছিলেন :
বাল্যকালে যাহারা বিধবা হইয়া থাকে, তাহারা যাবজীবন যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে, তাহা যাহাদের কন্যা, ভগিণী, পুত্ৰবধু প্রভৃতি অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছেন, তাহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছেন। কত শত বিধবারা, ব্ৰহ্মচৰ্যনিবাহে অসমর্থ হইয়া, ব্যভিচারদোষে দূষিত ও ভ্রূণহত্যাপাপে লিপ্ত হইতেছে; এবং পতিকুল, পিতৃকুল ও মাতৃকুল কলঙ্কিত করিতেছে। বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত হইলে, অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণা, ব্যভিচারদোষ ও ভ্রূণহত্যাপাপের নিবারণ ও তিনিকুলের কলঙ্ক নিরাকরণ হইতে পারে। যাবৎ এই শুভকরী প্ৰথা প্রচলিত না হইবেক, তাবৎ ব্যভিচারদোষের ও ভ্রূণহত্যাপাপের স্রোত, কলঙ্কের প্রবাহ ও বৈধব্যয়ন্ত্রণার অনল উত্তরোত্তর প্রবল হইতেই থাকিবেক।
বিদ্যাসাগর বিধবার বৈধব্যযন্ত্রণার, এবং তিনটি পাপের কথা বলেছেন : ব্ৰহ্মচৰ্যনির্বাহে অসামৰ্থ ব্যভিচারদোষ, ও ভ্ৰাণহত্যাপাপ। যন্ত্রণাটি সত্যিই বিধবার, কিন্তু পাপ তিনটি বিধবার নয়, নারীলোলুপ পুরুষের। পুরুষেরাই বিধবাদের পরিণত করে সহজ শিকারে। বিধবা মানেই সম্ভাব্য কলঙ্ক, এমন ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিলো সমাজে; সে যে একদিন কুলত্যাগিনী হবে, এ-বিষয়ে সমাজ ছিলো নিশ্চিত। প্রতিটি বিধবাকে বইতে হয় এমন কলঙ্কের বোঝা, যার জন্যে সে দায়ী নয়। বিধবা সম্পর্কে সমাজের এ-হীন ধারণার প্রতিবাদ করেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘নারীর মূল্য’-এ (১৯২৪)। বিদ্যাসাগরের বক্তব্য কিছুটা তরল ক’রে প্রচার করা হয়েছিলো যে বিধবাদের বিয়ে দেয়া হয় না ব’লে কুলত্যাগিনীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। শরৎচন্দ্র প্রশ্ন করেছেন, ‘কথাটা প্রচার করিবার সময, বিশ্বাস বদ্ধমূল করিয়া লইবার সময়, একবারও সে মনে করিয়াছে কি, কি গভীর কলঙ্কের ছাপ সে নারীত্বের উপর বিনা দোষে ঢালিয়া দিতেছে?” বিধবারা কেনো কুলত্যাগ করে? শরৎচন্দ্ৰ দেখিয়েছেন কামজ্বলায় নয়, বাস্তব দুৰ্গতি সহ্য করতে না পেরেই তারা কুলত্যাগ করে :
ভদ্ৰ-ঘরেক বিধবার অবস্থা ঠিক নীচজাতীয়া সধবার অনুরূপ। তাহাকেও স্বাধীনভাবে কায়িক পরিশ্রম করিয়া জীবিকা অর্জন করিতে দেওয়া হয় না, কারণ তাহাতে পিতৃকুলের বা শ্বশুরকুলের মর্যাদা হানি হয়, অথচ বাড়ির মধ্যে ভদ্ৰ-বিধবার অবস্থা কাহারো অবিদিত নাই। শতকরা সত্তরজন হতভাগিনী অন্ন-বস্ত্রের অভাবে এবং আত্মীয়-স্বজনের অনাদর, উপেক্ষা, উৎপীড়নেই গৃহত্যাগ করে, কামের পীড়নে করে না।
ভারতের স্বাধীনতার পর হিন্দুতন্ত্রের খড়গ কিছুটা কোমল হয়েছে। ১৯৫৫ সালে গৃহীত হয় হিন্দুবিবাহ অ্যাক্ট, যাতে দুটি মৌলিক পরিবর্তন সম্পন্ন করা হয়। এতে পুরুষের একবিবাহ, নারীর তো চিরকালই ছিলো, বিধিবদ্ধ করা হয়, এবং বিবাহবিচ্ছেদ স্বীকৃত হয়। সম্পত্তিতে এখন কিছুটা অধিকার এসেছে হিন্দুনারীর : ১৯৫৬র ‘হিন্দু উত্তরাধিকার অ্যাক্ট’ ও ১৯৫৯এর ‘বিবাহিত নারীর সম্পত্তি (পরিবর্ধিত) অ্যাক্ট’ নারীকে কিছুটা অধিকার দিয়েছে সম্পত্তির [দ্র আলমেনাস-লিপোস্কি (১৯৭৫, ৪৫-৫২)]। তবু আজো হিন্দু নারী পুরোনো বিধিবিধানের শিকার, এখনো স্বামীর পায়ের নিচে তার স্বৰ্গ হিন্দুবিধি পৃথিবীর একটি বিশেষ খণ্ডে সীমাবদ্ধ; কিন্তু যে-দুটি আইনের জগতে সূর্য কখনো ডোবে না, সে-দুটি হচ্ছে ইংরেজি সাধারণ আইন, ও রোমান আইন, পরে যার নাম হয় ‘কোড নেপোলিয়ন’ বা ‘নেপোলিয়নি বিধি’। দুটি বিধিই নারীর জন্যে নৃশংস; দুটিরই প্রণেতা নারীবিদ্বেষীরা, যারা নারীকে দেখছে প্রচণ্ড ঘৃণার চোখে, এবং আইনের নামে বিধিবদ্ধ করেছে বিনাবিচারে চরম দণ্ড। এ-দুটি বিধির পেছনে হিংস্র পিতৃতান্ত্রিকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে বাইবেল; প্রাণভরে শাস্তি দিয়েছে নারীকে। খ্রিস্টান সন্তরা নারীবিদ্বেষে হিন্দু ঋষিদেরও ছাড়িয়ে গেছেন; তাদের চোখে একটি নারী, মেরি, ছাড়া আর সব নারীই পাপিষ্ঠা; তাই তারা নারীদের জন্যে যে-সব বিধি রচনা করেছেন সেগুলো পাপিষ্ঠাদের জন্যে রচিত বিধি। ইহুদি ও খ্রিস্টান সন্তদের কাছে নারী হচ্ছে ‘শয়তানের খেলার মাঠ’, ‘বিষ্ঠার ছালা’; লুথার বলেছেন, নারী কখনো নিজের প্রভু নয়। ঈশ্বর তার দেহ তৈরি করেছে। পুরুষের জন্যে, সন্তান ধারণ ও লালনের জন্যে; নারীকে সন্তান বিয়োতে বিয়োতে মরতে দাও, এজন্যেই তাদের তৈরি করা হয়েছে।’[দ্র মাইলস (১৯৮৮, ৭৬, ৮০)]|