হিন্দু পিতৃতন্ত্রে তিন প্রধান পিতা, স্বামী, ও প্রভু; তাদের বর্তমানে কেউ সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। মনু [৮:৪১৬] বলেছেন : ‘ভাৰ্যা, পুত্র, ও দাস শাস্ত্রানুসারে অধম, তাই তারা যে-ধন উপার্জন করবে, তাতে তাদের অধিকার থাকবে না; তারা যার, ওই ধন হবে তার।’ স্ত্রী, পুত্র, দাস হচ্ছে স্বামী, পিতা, প্রভুর সম্পত্তি; তাই তারা সম্পত্তির মালিক হ’তে পারে না মালিকের জীবনকালে; এবং স্ত্রী ও দাস মালিক হ’তে পারে না কখনোই। পুত্ৰই যখন পিতার বর্তমানে নিজেরই অর্জিত ধনের মালিক হ’তে পারে না, তখন কন্যার ধনে অধিকারের কথাই ওঠ না ব’লে শ্লোকে মনু কন্যার উল্লেখও করেন নি। কন্যা উল্লেখযোগ্যও নয়। সে কোনো ধন উপার্জন করতে পারতো না; তবে পিতা তাকে স্বামীর কাছে বিক্রি ক’রে ধন অর্জন করতে পারতো। কন্যা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার যোগ্য নয়, যদি পিতার কোনো পুত্র থাকে। আদিকালে কোনো ভাই না থাকলে বোন উত্তরাধিকারী হতে পারতো। পিতার সম্পত্তির। তবে ভাইহীন নারীটি পিতার সম্পত্তি পেয়ে যে সুখের সাগরে ভাসতো, তা নয়; ওই ধন অভিশাপ হিশেবে দেখা দিতো তার জীবনে, কেননা অধিকাংশ সময় ভাইহীন নারীর বিয়েই হতো না। অপুত্ৰক পিতা পুত্রের শোকে কন্যাটিকেই ঘোষণা করে যেতো পুত্র হিশেবে; এবং নিজের বংশ রক্ষার জন্যে এমন ব্যবস্থা ক’রে যেতো যে ওই মেয়েটির প্রথম পুত্ৰ চ’লে আসবে মাতামহের বাড়ি, রক্ষা করবে তাঁর বংশ। পুত্র ও স্বৰ্গ হারানোর ভয়ে পুরুষেরা অমন মেয়েকে বিয়ে করতেই রাজি হতো না। তবে পুত্র থাকুক বা না থাকুক। মনু, বশিষ্ঠ, গৌতম কন্যার উত্তরাধিকার একেবারেই স্বীকার করেন নি। যাজ্ঞবল্ক, বৃহস্পতি, নারদ কন্যার কিছুটা উত্তরাধিকার স্বীকার করেছেন। ভাই থাকলে পিতার সম্পত্তিতে কন্যার অধিকারের কথাই ওঠে না, খ্রিপূ ৩০০ অব্দ থেকে হিন্দু আইনে পিতার সম্পত্তিতে কন্যার কোনো অধিকার নেই। পিতার বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে নারী যায় স্বামীগৃহে; এবং সেখানে সে পরিণত হয় আরেকজনের সম্পত্তিতে। স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তি, তাই স্ত্রীর কোনো সম্পত্তির অধিকার নেই, সে কোনো সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। মৈত্রায়নী সংহিতায় বিধান দেয়া হয়েছে : ‘সম্পত্তিতে নারীর কোনো অধিকার থাকবে না’; বলা হয়েছে : ‘স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর কোনো অধিকার থাকবে না ; হিন্দু স্ত্রীর শোচনীয় পরিণতি হচ্ছে বিধবা, যার জীবনেরই অধিকার ছিলো না, তাই তার সম্পত্তিতে অধিকারের কথা ভাবাও হাস্যকর। খ্রি:পূ: ৩০০ অব্দ থেকে কন্যা ও বিধবা পিতা ও স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত। বেদ আর অধিকাংশ ধর্মসূত্র বিধবার উত্তরাধিকার অস্বীকার করেছে। বৌধায়ন বিধবার উত্তরাধিকার অস্বীকার করেছে; আপস্তম্ব সাত স্তরের উত্তরাধিকারী বের করেছেন, এমনকি রাজাকে এবং ছাত্রকে উত্তরাধিকারী করেছেন, কিন্তু বিধবাকে করেন নি [দ্র আলতেকার (১৯৫৯, ২৫০-২৭০)]। বিধবার উত্তরাধিকার হচ্ছে সহমরণ, স্বামীর চিতার আগুনে ছাই হওয়া, বা দুৰ্গত কলঙ্কিত জীবন।
বিধবা হিন্দু পিতৃতন্ত্রের দুঃস্বপ্ন, তার খড়গের শোচনীয়তম বলি। ঋষিরা বিধবার জীবনকে অস্বীকার করেছে, আর যখন সে বেঁচে থেকেছে তখন তাকে চূড়ান্ত অপমান করেছে। বিধবাকে সতী নাম দিয়ে দাহ করার ব্যবস্থা করেছে হিন্দুবিধি। জেসাসের জন্মের অনেক আগে থেকেই একটি-দুটি ক’রে হিন্দু বিধবা সহমরণে ও অনুমরণে গেছে, বা যেতে বাধ্য হয়েছে। ৭০০ খ্রিস্টাব্দে থেকে সতীদাহ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আঙ্গরা বলেছেন, বিধবার ধর্ম হচ্ছে সহমরণ; হারীত বলেছেন, সহমরণ বরণ ক’রে স্ত্রী স্বামীকে চরম পাপ থেকে উদ্ধার করতে পারে। সতীদাহবাদীদের পবিত্র যুক্তি রামমোহন রায় ‘সহমরণ বিষয় প্ৰবৰ্ত্তক ও নিবৰ্ত্তকের সম্বাদ’-এ (১৮১৮, ৩-৪) দিয়েছেন প্রবর্তকের মুখে :
স্বামী মরিলে পর যে স্ত্রী এ পতির জ্বলন্ত চিতাতে আরোহণ করে সে অরুন্ধতী যে বশিষ্ঠের পত্নী তাঁহার সমান হইয়া স্বৰ্গে যায়। আর যে স্ত্রী ভৰ্ত্তার সহিত পরলোক গমন করে সে মনুষ্যের দেহেতে যত লোম আছে যাহার সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি তত বৎসর স্বৰ্গে বাস করে।….যে স্ত্রী ভৰ্ত্তার সহিত পরলোকে গমন করে সে মাতৃকুল পিতৃকুল এবং স্বামিকুল এই তিন কুলকে পবিত্র করে।…পতি যদি ব্ৰহ্মহত্যা করেন কিম্বা কৃতঘ্ন হয়েন কিম্বা মিত্রহত্যা করেন তথাপি ঐ পতিকে সৰ্ব্বপাপ হইতে মুক্ত করে ইহা অঙ্গিরা মুনি কহিয়াছেন।
সব বিধবা স্বামীর চিতায় ওঠে নি; কিন্তু এক সময় দাবানলের মতো জ্বলে উঠেছিলো সতীদাহের চিতা। এটা প্রথম ব্যাপক আকারে দেখা দেয়। উত্তর ভারতে ও কাশ্মীরে, প্রধানত রাজপরিবারে। রানীরা, এমনকি উপপত্নীরা, দলেদলে রাজাদের চিতায় উঠে সতী হ’তে থাকে। উত্তর ভারতের রাজপুতদের মধ্যে সতীদাহের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিলো বর্ণাঢ্য মড়করূপে। মারওয়ারের রাজা অজিত সিংহের চিতায় (১৭২৪) উঠেছিলো ৬৪টি সতী, পানিতে ডুবে বুন্দির রাজা বুধ সিং মারা গেলে তার চিতায় ওঠে ৮৪টি, ১৬২০ অব্দে এক রাজপুত রাজা মারা গেলে তার চিতায় উঠেছিলো ৭০০ সতী। হুমায়ুন ও আকবর সতীদাহ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কোনো কাজ হয় নি। বাঙলায়ও সতীদাহ ছিলো হিন্দুসমাজের স্বর্গীয় ও পার্থিব সুখের ব্যাপার। ১৮১৫-১৮২৮ সালের মধ্যে বাঙলায় ৩৭৮+৪৪২+৭০৭+৮৩৯+৬৫০+৫৯৮+৬৫৪+৫৮৩+৫৭৫+ ৫৭২+৬৩৯+৫১৮+৫১৭+৪৬৩=৮১৩৫ জন নারী সতী হয়। এ-সময়ে এতো সতী আর কোথাও হয় নি; বোম্বাই, মাদ্রাজ, এমনকি রক্ষণশীল বেনারসেও হয় নি। হিন্দুবিধি বিধবাকে সম্পত্তির অধিকার দেয় নি, আর নিয়তির পরিহাস হচ্ছে বাঙলায় একটি বিধিই বিধবাকে সম্পত্তির অধিকার দিয়ে তাকে ঠেলে দেয় চিতার আগুনে। দায়ভাগ আইনে বাঙলায় নিঃসন্তান বিধবারাও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো; তাই স্বজনেরা সম্পত্তির লোভে বিধবাদের ঠেলে দিতো স্বামীর চিতায়। সতীদাহের চিতার আগুনের রূপে কিন্তু মুগ্ধ ছিলেন কবিরা; কিশোর বয়সে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ’; এবং চল্লিশোত্তর বয়সে চিতার আগুনের শোভায় ভরে উঠেছিলো তার মন : ‘দাম্পত্যলীলার অবসানদিনে সংসারের কার্যক্ষেত্ৰ হইতে বিদায় লইয়া তেমনি সহজে বধূবেশে সীমান্তে মঙ্গলসিন্দূর পরিয়া পতির চিতায় আরোহণ করিয়াছ। মৃত্যুকে তুমি সুন্দর করিয়াছ, শুভ করিয়াছ, পবিত্র করিয়াছ; চিতাকে তুমি বিবাহশয্যার ন্যায় আনন্দময় কল্যাণময় করিয়াছ’ [বিচিত্ৰ প্ৰবন্ধ, ‘মা ভৈঃ’, ১৩০৯]। পিতৃতন্ত্রের খড়গের ক্ৰোধ থেকে নারীদের বাঁচানোর প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় উনিশ শতকে, যার সূচনাকারী রামমোহন রায় [১৭৭২-১৮৩৩]। নারীদের মর্মান্তিক পরিণতি ছিলো বিধবা, তাই বিধবাকে বঁচিয়েই রামমোহন শুরু করেন নারীবাঁচানোর আন্দোলন। ১৮২৯ সালে বেন্টিংক সতীদাহ নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করেন। সতীদাহ নিবারণে বেন্টিংক যে-ভূমিকা নেন, তার জন্যে হিন্দুবিধবার কৃতজ্ঞতা বেন্টিংকের বিশেষভাবেই প্ৰাপ্য।