পিতা রক্ষতি কৌমারে ভৰ্ত্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষন্তি স্থবিবে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।
নারীকে কুমারীকালে পিতা, যৌবনে স্বামী
ও বার্ধক্যে পুত্ররা রক্ষা কববে,
নারী কখনোই স্বাধীন থাকার যোগ্য নয়।
হিন্দুবিধানে বিয়ে বাধ্যতামূলক নারীর জন্যে, যে-প্রক্রিয়ায় নারীকে পরিণত করা হয় দাসীতে। কোনো নারী যদি অবিবাহিত থাকতে চায়, তবে হিন্দু পিতৃতন্ত্র তার ওপর চরম প্রতিশোধ নেয়; নারী ম’রেও বিয়ের শেকল থেকে মুক্তি পায় না।
মহাভারত-এ সুভরূ, ঋষি কুণির কন্যা, চিরকুমারী থাকে; মৃত্যুশয্যায় সে জানতে পারে যে সারাজীবন ধৰ্মপালন করেও সে স্বর্গে যেতে পারবে না, কেননা বিয়ের দ্বারা তার দেহ পবিত্র হয় নি। তাই অসহায় মুমূর্ষ কুমারীটি এক ঋষিকে বিয়েতে রাজি করিয়ে একরাত্রি তার সাথে কাটিয়ে স্বর্গে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। একটি সূত্রে রয়েছে কুমারী নারী মারা গেলেও তার লাশকে বিয়ে দিতে হবে, তারপরই হবে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া [দ্ৰ আলতেকার (১৯৫৯, ৩৩)]। পুরুষ দ্বারা দূষিত না হওয়া পর্যন্ত নারী পরিশুদ্ধ হয় না। বিয়ে দিতেই হবে, মানুষ না হ’লে বস্তুর সঙ্গে; যেমন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির প্রতিভাবান বিদ্রোহী তরুণী সরলা যখন কুমারী থাকার সিদ্ধান্ত নেন, তখন আলোড়ন তৈরি হয়ে যায়। স্বামী ছাড়া কী ক’রে থাকতে পারে একটি নারী, যতোই মেধাবী হোক? মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পুরুষতন্ত্রের মহিমা রক্ষার জন্যে মেয়েটিকে বিয়ে দিতে চান একটি খাপখোলা তলোয়ারের সাথে। তলোয়ারের সাথে পুরুষের বা পুরুষাঙ্গের মিল খুবই স্পষ্ট। হিন্দু বিয়ের অর্থ হচ্ছে নারীটির জন্যে জন্মজন্মান্তর ধ’রে একটি পুরুষ, এবং পুরুষটির জন্যে জন্মজন্মান্তর ধ’রে বহু নারী। হিন্দুপুরাণে বহুপতির কথা আছে, নারীদের কামোত্তেজনার মুহূর্তে যাকেতাকে আহ্বান করে গর্ভবতী হওয়ার কথাও আছে, কিন্তু হিন্দু বিয়ে হচ্ছে স্বামীর অধীনে নারীর কঠোর দাসীত্ব। স্বামীব প্ৰভুত্ব নিশ্চিত করার জন্যে ঋষিরা শ্লোকের পর শ্লোক লিখে স্বামীকে উত্তীর্ণ করেছেন ঈশ্বরের পর্যায়ে। স্বামী শব্দটিই বোঝায় ঈশ্বর। মনু [৫:১৫২] বলেছেন : ‘বিয়েতে যে বাগদান করা হয়, তাতেই নারীর ওপর পতির স্বামিত্ব জন্মে; সুতরাং স্বামীর সেবা করা নারীর কর্তব্য।’ এক শ্লোক পরেই তিনি বিধান দিয়েছেন :
পতি সদাচারহীন, পরদাররত বা গুণহীন হ’লেও সাধ্বী স্ত্রী পতিকে দেবতার মতো পুজো করবে [৫:১৫৪]
স্ত্রীদের স্বামী ছাড়া পৃথক যজ্ঞ নেই, পতির অনুমতি ছাড়া কোনো ব্ৰত বা উপবাস নেই। শুধু স্বামীসেবার সাহায্যেই নারী স্বৰ্গে যাবে [৫:১৫৫]।
স্বামীকে ক’রে তোলা হয়েছে গৃহের দেবতা, তবে গৃহে কোনো দেবী নেই, রয়েছে দাসী; দাসী স্ত্রীটি। স্বামীগৃহে নারীকে দাসী ক’রে রাখার বিধান দিয়েছেন মনু [৯:৩] সুচিন্তিত বাক্যে : ‘স্বামী ও স্বজনগণ স্ত্রীলোকদের দিবারাত্রির মধ্যে কখনো স্বাধীনভাবে থাকতে দেবেন না; কাজে ব্যস্ত রেখে সব সময় তাদের নিজেদের বশে রাখবেন।‘ হিন্দুবিধানে স্বামী কখনো মারা যায় না, স্বৰ্গলোকে যায়; তাই তার স্বৰ্গযাত্রার পরও নারী আর কোনো পুরুষের কথা ভাবতে পারবে না। মনু বলেছেন : ‘পতির মৃত্যু হ’লে স্ত্রী পবিত্র পুষ্পফলমূল দিয়ে অল্পাহারে দেহ ক্ষয় করবে, তবু পরপুরুষের নাম করবে না।’ [৫:১৫৭]; এবং যদি পরপুরুষের নাম নেয়, তাহলে রয়েছে শাস্তি : ‘পরপুরুষ উপভোগের ফলে নারী ইহকালে নিন্দিত হয়, পরকালে শৃগালযোনিতে জন্ম নেয় ও নানা পাপরোগে আক্রান্ত হয়’ [৫:১৬৪]। নারীটি তো আর পরপুরুষের নাম নেবে না, কিন্তু পুরুষটি কী করবে? মনু [৫:১৬৮] নিশ্বাসপ্রশ্বাসের মতো সহজ বিধান দিয়েছেন : ‘ভাৰ্যার মৃত্যু হ’লে দাহ ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ ক’রে পুরুষ আবার বিয়ে ও অগ্ন্যাধ্যান করবে।‘ পুরুষ কখনো কামবিরহিত থাকবে না, থাকবে নারী।
হিন্দুবিধানে নারীর মূল্য নারী হিশেবে নেই, স্ত্রী হিশেবেও নেই। তবে নারী দরকারী, কেননা সে সম্ভোগের বস্তু—‘রতিরুত্তমা’; এবং দরকারী কেননা এ-জন্তুটি উত্তরাধিকারী প্রসব করে। মনু [৯:২৬] বলেছেন : ‘সন্তান উৎপাদনের জন্যে স্ত্রীরা বহুকল্যাণভাগিণী, গৃহের দীপ্তি ও পূজনীয়া।’ স্ত্রীর সমস্ত কৃতিত্ব হচ্ছে প্রজনন। তাদের কাজ পিতার উত্তরাধিকারী, এবং পুত নরক থেকে ত্রাণকারী, পুত্র জন্ম দেয়া; কন্যা জন্ম দেয়া অপরাধ। আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে : ‘পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়াই নারীর প্রধান কর্তব্য’; মৈত্রায়নী সংহিতায় বলা হয়েছে: ‘নারীর প্রকৃষ্ট কর্তব্য হচ্ছে পুত্র উৎপাদন করা’ [দ্র সুকুমারী (১৯৮৯)]। কন্যা শুধু হিন্দুসমাজেই নয়, সব সমাজেই অবাঞ্ছিত; তবে হিন্দু পিতৃতন্ত্র কন্যাকে ভয় পেয়েছে ও অসহায় ক’রে রেখেছে সবচেয়ে বেশি। অথর্ববেদ-এ পুত্ৰলাভের ও কন্যানিরোধের মন্ত্র রয়েছে। কন্যানিরোধ না ক’রে কোনো উপায় ছিলো না; হিন্দু পিতৃতন্ত্র তার বিধিবিধানে নারীর জীবনকে এমন নারকীয় ক’রে তুলেছিলো যে কন্যা কামনাই ছিলো নিষ্ঠুরতা। মেয়েকে লেখাপড়া শেখানো যাবে না, বিয়ে দিতে হবে শৈশবে [তিরিশ বছরের পুরুষ বারো বছরের কন্যাকে বিয়ে করবে; চব্বিশ বছরের পুরুষ আট বছর বয়সের কন্যাকে বিয়ে করবে, নইলে ধর্ম নষ্ট হয়: [মনুসংহিতা, ৯:৪], কিন্তু আন্তবর্ণ বিয়ে নিষিদ্ধ ব’লে বর পাওয়া যাবে না, সে কোনো কিছুর উত্তরাধিকারী হবে না, স্বামীর মৃত্যু হ’লে তাকে আর বিয়ে দেয়া যাবে না, তাকে তুলে দিতে হবে স্বামীর চিতায়, হিন্দু পিতৃতন্ত্রে এ হচ্ছে নারীর সম্পূর্ণ জীবনী।