নারীর প্রতিদিনের জীবন শৃঙ্খলিত যে-আইনের শেকলে, তা হচ্ছে ব্যবহারিক বা অধিকার বিধিগুলো [সিভিল ল], বিশেষ ক’রে বিবাহ ও পারিবারিক বিধিগুলো। এর কিছু প্রথা হিশেবে চলে এসেছে, কিছু বিধিবদ্ধ হয়েছে; তবে এগুলো নারীর জীবনকে পরিণত করেছে নরকে। অধিকার আইনেই বিধিবদ্ধ হয়ে আছে নারী কখন কীভাবে বিয়ে বসতে বা করতে পারবে, কীভাবে বিয়ে ভাঙতে পারবে না বা পারবে, সন্তানের ওপর তার অধিকার কতোটা, সে কী ধরনের সম্পত্তির মালিক হ’তে পারে না বা পারে, ওই সম্পত্তির ওপর তার কতোটা অধিকার থাকবে, কী কী শর্তে সে ব্যবসাবাণিজ্যে জড়িত হতে পারে, বিধবা অবস্থায় সে হতে পারে কতোটা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, বিয়ে ভেঙে গেলে সে কতোটা ধন দাবি করতে পারে প্রভৃতি। এর সব এলাকায়ই পুরোনো আইন নারীর জন্যে ভয়াবহ, তা সাধারণত নারীর কোনো অধিকার স্বীকার করে না, যদিও এখন নানা সংস্কার করা হচ্ছে। অধিকার আইনগুলো কোনো সুসংবদ্ধ সংহত বিধি নয়, এগুলো বিচিত্র বিভীষিকাজাগানো বিধির সমষ্টি। এগুলোর ভেতরে রয়েছে। নানা স্ববিরোধিতা; হয়তো সংবিধানে উচ্চকণ্ঠে নারীকে দেয়া হয়েছে। পুরুষের সমান অধিকার, কিন্তু বিয়ের আইনে চুপচাপ বিধিবদ্ধ হয়েছে যে স্ত্রী স্বামীর দাসী, বা নারীকে দেয়া হয় নি ভোটাধিকার, এমনকি নিজের ইচ্ছেমতো বাইরে বেরোনোর অধিকার। নারীর আইনগত অধিকার এখনো অনেক কম পুরুষের তুলনায়। ওই পুরোনো আইনগুলো বিভিন্ন ব্যাপারে পোষণ করে বিভিন্ন বিরোধী বিশ্বাস, কিন্তু এক ব্যাপারে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে গভীর ঐক্য, সেটা নারীপীড়নে; নারীপীড়নে সব বিধিই সমান নির্মম। কয়েক হাজার বছর ধরে এ-বিধিপুঞ্জ নারীকে যেভাবে পীড়ন করেছে, ক্রীতদাসদেরও ততোখানি পীড়ন করা হয় নি। ওই আইনে কেড়ে নেয়া হয়েছে নারীর সব মানবিক ও সামাজিক অধিকার, এমনকি নিজের শরীরের ওপর তার নিজের অধিকার। পুরুষতন্ত্রের খড়গের নিচে নারী যাপন করেছে রক্তাক্ত জীবন, কিন্তু তাকে হাহাকার করার আইনগত অধিকারও দেয়া হয় নি।
পিতৃতন্ত্রগুলোর মধ্যে মানুষ ও নারীর বিরুদ্ধে সৰ্বগ্রাসী ষড়যন্ত্রে সবচেয়ে নিপুণ হিন্দু পিতৃতন্ত্র। অন্যরা যা করেছে বলপ্রয়োগে, হিন্দু পিতৃতন্ত্র করেছে যেনো মন্ত্রপ্রয়োগে; নিষ্ঠুরতম শোষণপীড়নকেও তারা ব্ৰহ্মার বিধান ব’লে গ্রহণযোগ্য ক’রে তুলেছে। হিন্দু পিতৃতন্ত্রে সমাজের অধিকাংশ মানুষই বলি; এবং নারী ওই খড়গের নৃশংসতম বলি। যে-সমস্ত বিধি দিয়ে কয়েক হাজার বছর ধ’রে হিন্দুনারীর জীবন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তার অধিকাংশই প্রথাগত; ওই সমাজে ঋষির পর ঋষি জন্ম নিয়েছে, ব্ৰহ্মার সাথে আলাপ ক’রে এসে তারা বিধান লিখেছে, এবং সবাই মিলে নারীকে ক’রে তুলেছে পুরুষের শিকার। হিন্দু বিধানগুলো নারীপীড়নের স্বর্গীয় অনুমতিপত্র। হিন্দু আইনের প্রধান উৎস বেদ; হিন্দুরা যেমন পুরুষের তৈরি সমস্ত কিছুকেই ব্ৰহ্মার মুখনিসৃত ব’লে প্রচার করেছে, তেমনি আইনকেও ক’রে তুলেছে ঐশ্বরিক, চিরন্তন, শাশ্বত, অবিনাশী। হিন্দু আইনের প্রথম ও প্রধান প্রণেতা মনু। মনু দাবি করেছেন যে ব্ৰহ্মা প্রথম আইন প্রণয়ন ক’রে তাকে শেখায়, এবং তিনি সে-আইন শেখান মরীচি ও অন্য ন-জন ঋষিকে [দ্র মনুসংহিতা, ১১:৫৮]। বেদ, শ্রুতি, ভাষ্য, প্রথার সমষ্টি হচ্ছে হিন্দু আইন। হিন্দু আইনে নারীর কোনো মূল্য নেই, নারী অস্থাবর সম্পত্তিমাত্র; নারী কোনো সম্পত্তির মালিক হতে পারে না, পারে না সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে। পিতৃতন্ত্র নারীকে অস্তিত্বহীন করার জন্যে যে-ফাঁদটি পেতেছে, এবং যাতে ঢুকতে বাধ্য করেছে, তার নাম বিবাহ। মনু [৯:২২] বলেছেন, ‘নদী যেমন সমুদ্রমিলনে লবণায়ু হয়, নারীও তেমন; যেমন পুরুষের সাথে বিবাহিত হয় তেমন গুণযুক্ত হয়।’ নারী নির্গুণ, আর পুরুষ গুণের মহাসাগর, যেখানে অস্তিত্ব হারিয়ে নারী ধন্য হয়। বিয়ে হচ্ছে নারীর অস্তিত্বলোপ; এ-বিষয়ে হিন্দু ও খ্রিস্টান একমত। হিন্দু পিতৃতন্ত্রে নারীকে বিয়ের ফাঁদে আটকে রাখার সুপরিকল্পিত বিধি তৈরি করা হয়েছে। মনু [২:৬৭] বিধান দিয়েছেন :
বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদকঃ স্মৃতঃ। ।
পতিসেবা গুরৌবাসো গৃহার্থোহগ্নিপরিক্রিয়া৷
বিয়েই নারীর বৈদিক উপনয়ন,
পতিসেবা হচ্ছে গুরুগৃহবাস, এবং গৃহকর্মই
প্রভাত ও সন্ধ্যায় হোমস্বরূপ অগ্নিপরিচর্যা।
হিন্দু নারীর অধিকার নেই কোনো কিছুতে; মন্ত্রে নেই, শিক্ষায় নেই, ধর্মে নেই। ব্ৰাহ্মণ বালকের জীবনে উপনয়ন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, উপনয়ন তার সামনে বিদ্যা ও ধর্মের পথ খুলে দেয়; কিন্তু নারীর উপনয়নের অধিকার নেই, তাই নারী বেদপাঠ করতে পারে না, পুজোয় উৎসর্গ করতে পারে না। [ দ্র দ্বারকানাথ (১৯১৩, ৯৬-৯৭)]। বিয়েই তার জীবনকারাগার। বঙ্কিম ‘দাম্পত্য দণ্ডবিধির আইন’ [লোকরহস্য, ১৮৭৪] নামে একটি কৌতুককর রচনা লিখেছিলেন, কিন্তু নারীর চোখে দেখলে রচনাটিকে মনে হয় বেদনাদায়ক; পুরুষের জন্যে যা কৌতুক, নারীর জন্যে তা মৃত্যু। ‘পূৰ্ব্বজন্মকৃত পাপের জন্য পুরুষের প্রায়শ্চিত্তবিশেষকে বিবাহ বলে’ সংজ্ঞাটিকে একটু বদলে পুরুষের জায়গায় ‘নারীর’ বসালেই সংজ্ঞাটি হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর সত্য। বঙ্কিম বলেছেন, ‘অধীন যে সচল অস্থাবর সম্পত্তি, তাহাকে স্বামী বলা যায়’ : উনিশশতকের ঋষির সংজ্ঞা কৌতুক; কিন্তু সনাতন ঋষিাদের সংজ্ঞায় স্ত্রী স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তিই। তা লোকরহস্য নয়, কয়েক হাজার বছরের মর্মান্তিক সত্য। নারী অসম্পূর্ণ মানুষ, যার শক্তি নেই নিজেকে রক্ষার। হিন্দু ঋষিরা ও বাইবেলের সন্তরা এ-বিষয়ে একমত; নারীকে তারা বিন্যস্ত করেছেন শিশু ও উন্মাদের শ্রেণীতে। মনুর [৯:৩] বিধানে নারী চিরস্বাধিকারহীন অসহায় শিশু: