উৎপাদন বা আর্থ ক্রিয়াকাণ্ডে যার অংশ নেই, দুরবস্থা তার কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। নারীর দুরবস্থার কারণ তাই নারী বহুকাল ধ’রে আর্থ ক্রিয়াকলাপ থেকে নিবাসিত হয়ে পরগাছায় পরিণত হয়েছে। নারী আর্থনীতিকভাবে শোষিত, তাই সব দিকেই শোষিত। আদিম সাম্যতন্ত্রী গৃহস্থালিতে নারীর ওপর অর্পিত ছিলো গৃহস্থালি, তা আজকের পরিবার সেবা ছিলো না, ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বৃত্তি। কিন্তু পিতৃপ্রধান পরিবার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গৃহস্থলির কাজের মূল্য কমে যায়; বৃত্তির বদলে তা হয়ে ওঠে সেবা, যার দরকার আছে কিন্তু মূল্য নেই। সামাজিক উৎপাদনের এলাকা থেকে বহিস্কৃত হয়ে স্ত্রী হয়ে ওঠে প্রথম ঘরোয়া ঝি। আধুনিক পরিবার দাঁড়িয়ে আছে নারীর প্রকাশ্য বা গোপন গাৰ্হস্থ দাসত্বের ওপর; এঙ্গেলস বলেছেন, পরিবারের মধ্যে স্বামী হচ্ছে বুর্জোয়া, স্ত্রী প্রলেতারিয়েত। কারণ বিত্তবান শ্রেণীগুলোতে পুরুষ উপার্জন করে, নারী কোনো কিছু উপার্জন করে না; তাকে এমনভাবে নিষ্ক্রিয় ক’রে দেয়া হয়েছে যাতে সে হয়ে উঠেছে আপাদমস্তক অপদার্থ। পানী শ্রেণীগুলোতে নারীদের ক’রে তোলা হয়েছে অপদার্থতার প্রতিমূর্তি; পুরুষের বিনোদ যোগানোর বেশি আর কিছু তারা করতে পারে না ; মানুষের হাতেপায়ে শেকল পরানো সহজ, কঠিন হচ্ছে শেকলমুক্ত করা; আর ওই শেকল যদি সুবিধাজনক হয়, তবে মানুষ মুক্তির চেয়ে শেকলকেই বেশি প্রিয় মনে করে। এটা ঘটেছে বুর্জোয়া নারীদের বেলা; তারা কারুকার্যখচিত শেকলকেই বরণ ক’রে নিয়েছে। ওই শেকল তাদের স্বাধীনতা ও সম্মান হরণ করেছে, কিন্তু নানা সুবিধা এনে দিয়েছে বলে শোকলে তারা নিজেদের আরো শক্ত করে বেঁধে রাখতে চায়। একপতিপত্নী বিয়েতে নারী সব স্বাধীনতা হারিয়েছে, দাসী হয়ে উঠেছে; তার সমষ্টি বিয়ের যৌন স্বাধীনতা হারিয়েছে, কিন্তু পুরুষ সমষ্টি বিয়ের সুবিধা হারায় নি। পুরুষদের জন্যে আজো রয়ে গেছে সমষ্টি বিয়ে। মুসলমানেরা বহু বিয়ে করতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় সবাই বহু বিয়ে ক’রে থাকে; এবং পৃথিবী জুড়েই পুরুষেরা উপভোগ করে বিয়ের বাইরে জাকালো যৌনসম্পর্ক। নারীর পক্ষে যা মারাত্মক অপরাধ, পুরুষের বেলা তা অনেক সময় গৌরবের বা আনন্দের সাথে উপভোগ্য নিন্দার ব্যাপার। একই পুরুষের অধিকারে প্রচুর সম্পত্তি জড়ো হওয়ার ফলে, এবং তাঁর সন্তানসন্ততিকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করার বাসনা থেকে উদ্ভূত হয় একপতিপত্নী বা একপতি-একাধিক পত্নী বিয়ে;- সম্পূর্ণ পুরুষের স্বার্থে। এজন্যে নারীর পক্ষে একপতিত্ব বাধ্যতামূলক, পুরুষের জন্যে নয়।
এঙ্গেলস পিতৃতান্ত্রিক বিয়ে ও পরিবারের উদ্ভব ও প্রকৃতির যে-ব্যাখ্যা দেন, তা বিপ্লবাত্মক; কেননা তিনি দেখান যে এর কোনোটিই শাশ্বত নয়। যা বহুকাল ধ’রে চ’লে এসেছে, তাই যে চিরকাল চলবে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। পিতৃতান্ত্রিক বিয়ে, পরিবার ও আর সমস্ত কিছু ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত-বিবর্তিত হয়েছে, এখনো বিবর্তন চলছে; এমনকি এর আমূল পরিবর্তনও ঘটানো অসম্ভব নয়। তিনি দেখান যে পিতৃতান্ত্রিক বিয়ে ও পরিবার গড়ে উঠেছে নারীকে পুরুষের সম্পত্তিতে পরিণত করে। নারীশোষণই পিতৃতন্ত্রের ভিত্তি, যার সাথে যুক্ত আরো নানা ধরনের শোষণ। এ-সমস্ত শোষণের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে রাষ্ট্র, যার কাজ বিচিত্র ধরনের শোষণ ও বৈষম্যকে বৈধ ক’রে তোলা। তাই সমস্ত মানবিক বৈষম্যের মূলে রয়েছে। পুরুষাধিপত্য ও নারীর অধীনতা, লৈঙ্গিক রাজনীতির ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে সমস্ত সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থ সংগঠন। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২২) বলেছেন :
ইতিহাসে শ্রেণী-বিরোধ প্রথম যা দেখা দেয় সেটা মিলে যায় একপতিপত্নী বিবাহে স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে বিরোধের বিকাশের সঙ্গে এবং প্রথম শ্রেণী পীড়ন মেলে পুরুষ কর্তৃক স্ত্রীজাতির ওপর পীড়নের সঙ্গে। একপতিপত্নী বিবাহ ইতিহাসের একটি বড় অগ্রসর পদক্ষেপ, কিন্তু সেই সঙ্গেই দাসপ্রথা ও ব্যক্তিগত সম্পদসহ তা এমন এক যুগের পত্তন করে যা আজও পর্যন্ত চলছে এবং যাতে প্রত্যেকটি অগ্ৰগতিই হচ্ছে সেই সঙ্গে একটা আপেক্ষিক পশ্চাদগতি, যেখানে জনসমষ্টির একাংশের সচ্ছলতা ও উন্নতি হয় অপর এক অংশের দুঃখ ও পীড়নেৰ মধ্য দিয়ে। একপতিপত্নী বিবাহ হচ্ছে সভ্য সমাজের কোষ-রূপ, এখানে আমরা সেই সব বৈরিতা ও বিরোধের প্রকৃতি লক্ষ্য কবতে পারি যেগুলি শেষোক্তের মধ্যে পূর্ণ পরিণতি লাভ করেছে।
বৈরিতা ও বিরোধের ভিত্তির ওপর যা দাঁড়িয়ে আছে, তা কি ধ’সে পড়বে না? এঙ্গেলস স্বপ্ন দেখেছেন এক শোষণহীন সমাজের; তাই যে-আর্থনীতিক শোষণের ওপর দাঁড়ানো একপতিপত্নী বিয়ে ও পরিবার, যদি সে-শোষণ চলে যায়, তবে কি থাকবে এ-বিয়ে ও পরিবার? এর চমকপ্ৰদ উত্তর দিয়েছেন এঙ্গেলস; বলেছেন, ‘এই প্রথা লোপ না পেয়ে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হবেই।’ ওই সমাজে সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে আবার ফিরে আসবে নারী–এটাই তাদের মুক্তির প্রথম শর্ত; এবং ওই সমাজে উৎপাদনের উপায়গুলো হবে সমাজের সম্পত্তি, সেখানে কেউ সুবিধাভোগী কেউ সর্বহারা হবে না। তাই নারী হবে স্বাধীন, সেখানে পতিতা থাকবে না কেউ, এবং একপতিপত্নী প্রথা সত্য হয়ে উঠবে পুরুষনারী উভয়ের জন্যে। পরিবারের রূপ থাকবে না এখনকার মতো, এখন পরিবার হচ্ছে সমাজের অর্থনীতির একক, এঙ্গেলসের সমাজে তা হবে না। সেখানে ‘ব্যক্তিগত গৃহস্থলি পরিণত হবে সামাজিক শিল্পে।‘ শিশুপালন ও শিক্ষা হবে সামাজিক ব্যাপার, বিয়ে বা বিয়ের বাইরে যেভাবেই জন্ম হোক শিশুর, পুরো সমাজ নেবে তার দায়িত্ব, সে হবে সমাজের সন্তান। একপতিপত্নী বিয়েকে শুদ্ধ পবিত্র স্বর্গীয় ক’রে তোলা এঙ্গেলসের লক্ষ্য নয়; তার লক্ষ্য নারীর ওপর পুরুষের শোষণ এবং সার্বিক শোষণ দূর করা। তা কিছুতেই বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সম্ভব নয়। আমাদের উগ্র পুরুষতান্ত্রিক, মধ্যযুগীয়, দরিদ্র, অশিক্ষিত সমাজে নারীশোষণ বন্ধ করা বিশেষভাবেই কঠিন; নারীর মুক্তি তো সুদূর ব্যাপার। এখানে একটি ভালো বিয়েকেই নারীর জীবনের পরম সাফল্য ব’লে গণ্য করা হয়; এর বেশি এখনো ভাবা হয় না ; বরং মুক্তিকে মনে করা হয় বিপজ্জনক ও ব্যর্থতা। পশ্চিমের নারীবাদীরা এঙ্গেলসকেও ছাড়িয়ে গেছেন; তাঁরা একপতিপত্নী বিয়ের পবিত্রতাকে বিশেষ মূল্যবান মনে করেন না, তারা নারীর সামাজিক-আর্থ-যৌন সব ধরনের মুক্তি চান। গত তিন দশকে পশ্চিমের নারীবাদীরা বদলে দিয়েছেন তাদের সমাজের বহু এলাকা; এবং যৌন এলাকায় যে-পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, তাকে বিপ্লব বলা যায়। তবে পৃথিবী এখনো পুরুষের, নারী এখনো পরাজিত, বন্দী। নারীর মুক্তির জন্যে দরকার বড়ো ধরনের সামাজিক বিপ্লব; যতোদিন ওই বিপ্লব না ঘটে ততোদিন নারী থাকবে পুরুষের অধীনে, থাকবে দাসী ও যৌনসামগ্ৰী।
পিতৃতন্ত্রের খড়গ : আইন বা বিধিবিধান
পিতৃতন্ত্র প্রণয়ন করেছে বিপুল পরিমাণ আইন বা বিধিবিধান, যার এক নৃশংস অংশ সুপরিকল্পিতভাবে বানানো হয়েছে নারীদের পীড়নের জন্যে। পিতৃতন্ত্রের আইনসংশ্রয়টি তার বলপ্রয়োগ সংস্থা, যার বিধিগুলো এক বহুমুখি হিংস্র খড়গ, যা নারীর জীবনের দিকে উদ্যত হয়ে আছে কয়েক হাজার বছর ধরে, এবং ওই খড়গের ধারাবাহিক বলি নারী। ওই বিধিগুলো তৈরি করেছে পুরুষ, তৈরির সময় নারীর কোনো বক্তব্য শোনে নি; নারী সম্পর্কে প্রথম থেকে শেষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পুরুষ, তার শাস্তির সব বিধি প্রণয়ন করেছে নারীবিরোধী পুরুষতন্ত্র। পুরুষ নিজে প্রণয়ণ করেছে ওই নিষ্ঠুর সংহিতাগুলো, নারীকে স্থান দিয়েছে দণ্ডিতের শ্রেণীতে; ওই বিধিগুলোকে প্রচার করেছে ঐশী ব’লে। পুরুষ তার পুরুষ বিধাতার হাতে লিখিয়ে নিয়েছে নিজের রচনা; বিধাতা হয়ে উঠেছে। পুরুষের প্রস্তুত বিধানের শ্রুতিলিপিকর। পুরুষ একই সাথে নারীর বিরুদ্ধে বাদী, বিধিরচয়িতা ও বিচারক: নারীর তাতে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারও নেই। পলা দ্য লা বার বলেছেন, ‘পুরুষেরাই প্রণয়ন করেছে সমস্ত আইন, তাই তারা পক্ষপাত দেখিয়েছে নিজেদের লিঙ্গের প্রতি, আর বিচারকেরা ওই সমস্ত বিধিবিধানকে উন্নীত করেছে নীতির স্তরে’ [দি দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ২২)]। পুরুষ জানে তার তৈরি বিধি নারীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, নারী মেনে নেবে না ওই দণ্ডাদেশ; তাই পুরুষ সেগুলোকে ঘোষণা করেছে ঐশী, এবং পুরুষাধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেদের স্বর্গীয় শাশ্বত অধিকার ব’লে। পুরুষের লেখা বিধিবিধানে নারী চিরদণ্ডিত। পৃথিবীর নারীসমাজ এখন প্রধানত পাঁচ ধরনের আইনের অধীনে জীবনদণ্ড ভোগ করছে, যার মাঝে চারটিকে বলা যায় সনাতন, যেগুলোর উৎস ধর্ম ; হিন্দু আইন, ইংরেজি সাধারণ আইন [ইংলিশ কমন ল], রোমান আইন [রোমান ল], ইসলামি আইন [শরিয়া]; আর পঞ্চম ধরনের আইনগুলো প্রণীত হয়েছে এ-শতকে, যেগুলো চলছে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে। পুরোনো সমস্ত আইন নারীকে পীড়নের জন্যেই তৈরি করা হয়েছিলো, ওগুলোর লক্ষ্য ছিলো নারীকে মানুষের স্তরে উঠতে না দেয়া; আর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বিধিবিধান যদিও নারীকে দিয়েছে প্রচুর স্বাধীনতা ও অধিকার, তবু নারী সেখানেও মানুষেব স্বাধীনতা ও অধিকার পায় নি। পুরুষের তৈরি আইনে পুরুষের সুবিধার শেষ নেই, পুরুষের সুবিধার সাম্রাজ্যে সূৰ্য কখনো অস্ত যায় না; আর নারীর অসুবিধার অমারাত্ৰিও কখনো কাটে না। পিতৃতন্ত্রের বিধিবিধানের খড়গের নিচে বেঁচে আছে চিরদণ্ডিত নারী।