বর্বরতার মধ্য স্তর থেকে শেষ স্তরে ওঠার সময় জোড়বাধা বিয়ে থেকে উদ্ভব ঘটে একপতিপত্নী বিয়ের। সভ্যতার সূচনার সময় একপতিপত্নী বিয়েই রীতি হয়ে ওঠে। এর ভিত্তি পুরুষাধিপত্য, লক্ষ্য সুনিশ্চিত পিতৃত্বে সন্তান উৎপাদন। তখন বাপই সমস্ত সম্পত্তির মালিক; আর বাপ এমন কাউকে সম্পত্তি দেবে না, যে তার ঔরষে জন্ম নেয় নি : বাপের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে সন্তান, বিশেষ করে পুত্র। এ-বিয়েতে স্বামীস্ত্রীর খেয়ালে বিয়ে ভাঙা সম্ভব নয়, তবে স্বামী তা পারে বেশ সহজে। এ-বিয়েতে দাম্পত্যজীবনে পুরুষের বিশ্বাসভঙ্গের অধিকারও থাকে খুবই বেশি; কিন্তু নারীর কোনো অধিকার থাকে না। এমন একপতিপত্নী পরিবারের কঠোর রূপ দেখা দেয় গ্রিকদের মধ্যে। সেখানে পুরোনো দেবীদের যে-প্রতিষ্ঠা, তা থেকে বোঝা যায় নারীরা তখন সম্মানিত ছিলো, কিন্তু বীরযুগে পতন ঘটে নারীদের অবস্থার। তখন দেখা যায় পুরুষেরা বিয়ের বাইরে যৌনসম্পর্ক রাখছে, কিন্তু নারীরা বাধ্য হচ্ছে কঠোর সতীত্ব বা পাতিব্ৰত্য পালন করতে। সভ্যতার যুগে নারী হয়ে ওঠে। পুরুষের বৈধ উত্তরাধিকারীর জননী, তার প্রধান গৃহকত্রী, দাসীদের প্রধান। স্বামীরা দাসীদের নিয়মিত সম্ভোগ করতো, বাইরে গণিকা উপভোগ করতো; কিন্তু স্ত্রীদের থাকতে হতো আপাদমস্তক সতী। তাই একপতিপত্নী বিয়ে নির্মমভাবে সত্য হয় শুধু নারীর জন্যে, পুরুষের জন্যে নয়। ডেমোসথেনেস বলেছেন, ‘চেতনার সুখের জন্যে আমাদের আছে গণিকা, ইন্দ্ৰিয়সুখের জন্যে রক্ষিতা, এবং পুত্রলাভের জন্যে স্ত্রী’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১১৯)]। পুরোনো ভারতে পুরুষ বিয়ে করতো বহু, তার ওপরে ছিলো বিচিত্র ধরনের বেশ্যা, যাদের শ্ৰেষ্ঠ ছিলো ‘গণিকা’। বাৎস্যায়ন লিখেছেন, ‘চৌষট্টিকলায় উৎকর্ষ লাভ ক’রে শীল, রূপ ও গুণান্বিতা বেশ্যা ‘গণিকা’ সংজ্ঞা লাভ করে এবং গুণগ্রাহীদের সমাজে স্থান লাভ করে। রাজা সর্বদা তাকে সম্মান করেন, গুণবানেরা তার স্তুতি করেন এবং সে সকলের প্রার্থনীয়া, অভিগম্য ও লক্ষীভূত হয়ে থাকে’ [কামসূত্র: দ্ৰ মহেশচন্দ্র (১৯৮০)]। কিন্তু স্ত্রীরা রাজা কেনো স্বামীদের কাছেও সম্মানিত ছিলো না।
একপতিপত্নী বিয়ে দেখা দেয় নি নারীপুরুষের সদ্ভাবের ফলে, বা বিয়ের একটি আদর্শ রূপ হিশেবে। এটি দেখা দিয়েছিলো নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্যরূপে; এবং এখনো তাই আছে। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২২) বলেছেন, ‘ইতিহাসে শ্রেণীবিরোধ প্রথম যা দেখা দেয় সেটা মিলে যায় একপতিপাতী বিবাহে স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে বিরোধের বিকাশের সঙ্গে এবং প্রথম শ্রেণীপীড়ন মেলে পুরুষ কর্তৃক স্ত্রীজাতির ওপর পীড়নের সঙ্গে।‘ একপতিপত্নী বিয়ে অগ্রগতি, কিন্তু পেছনে ফেরাও, কেননা এর ভিত্তি নারীর ওপর পুরুযের শোষণ। পবিত্র একপতিপত্নী বিয়ের সাথে দেখা দেয় দুটি অপবিত্র ব্যাপার, যা আগে ছিলো না; একটি গণিকাবৃত্তি, অন্যটি ব্যভিচার। গণিকাবৃত্তির শুরু হয়েছিলো প্ৰায়শ্চিত্তমূলক দেহদানে, যখন নারীরা প্রণয়দেবীর মন্দিরে অর্থের বিনিময়ে আত্মদান ক’রে প্রায়শ্চিত্ত করতো সতীত্বের। অর্থ জমতো মন্দিরের কোষে। আর্মেনিয়ার আনাইটিসের মন্দির ও করিন্থের আফ্রোদিতির মন্দিরের পরিচারিকারী ও ভারতের মন্দিরের দেবদাসীরা ছিলো প্ৰথম গণিকা। সম্পত্তির বৈষম্য শুরু হওয়ার পর ক্রীতদাসীরা যখন বাধ্য হয় প্রভুকে দেহদানে, তখন শুরু হয় স্বাধীন নারীদের পতিতাবৃত্তি। স্বামীরা পতিতা সম্ভোগ করতো, তাতে কোনো বাধা ছিলো না; কিন্তু স্ত্রীরা ছিলো অবহেলিত। স্ত্রীরা শুধু চোখ বুজে দেখে যাবে স্বামীদের লাম্পট্য, থাকবে সতীসাধ্বী, এটা আশা করা যায় না; তারাও যে হাত বাড়াবে নিষিদ্ধ গন্ধমের দিকে, এটাই স্বাভাবিক। তাই দেখা দেয় একটি নতুন প্রপঞ্চ, যার নাম স্ত্রীর উপপতি; শুরু হয় নারীর ব্যভিচার। একপতিপত্নী বিয়ের মধ্যে স্বামীর দিক থেকে থাকে গণিকাসম্ভোগ, আর স্ত্রীর দিক থেকে থাকে, এঙ্গেলসের মতে, ‘ঢালাও ব্যভিচার’। বাইবেলেব হিতোপদেশ বলেছে, ‘পরকীয়া স্ত্রীর ওষ্ঠ হইতে মধু ক্ষরে, তাহাব তালু তৈল অপেক্ষাও স্নিগ্ধ’; এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৬) বলেছেন, ‘মৃত্যুর মতোই ব্যভিচারের কোন চিকিৎসা নেই।‘ এ-বিয়ের সুখ কেমন? এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৬) বলেছেন, ‘একপতিপত্নী বিবাহের উত্তম দৃষ্টান্তগুলির গড়পড়তা ধরলেও তা পরিণত হয় এক নিরেট একঘেয়েমির দাম্পত্য-জীবনে, যাকে বলা হয় দাম্পত্য সুখ।’ এ-বিয়ে পরিণত হয, এঙ্গেলসের মতে, স্থল বেশ্যাবৃত্তিতে, বিশেষ ক’রে স্ত্রীর বেলা। স্ত্রী আর পতিতা কি এক? এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৭) বলেছেন, ‘স্ত্রীর সঙ্গে সাধারণ পতিতার পার্থক্য এইটুকু যে সে ফুরনের মজুরের মতো নিজের দেহ ভাড়া খাটায় না, পরন্তু সে দেহটা বিক্রি করে চিরকালের মতো দাসত্ত্বে; এবং ফুরিয়ের [ দ্র এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৭)] বলেছেন, ‘ব্যাকরণে যেমন দুটি নেতিবাচক শব্দে একটি ইতিবাচক শব্দ হয়, তেমনই বিবাহের নীতিশাস্ত্রে দুটি বেশ্যাবৃত্তি মিলে পুণ্যধর্ম হয়ে ওঠে। সাম্যবাদী এঙ্গেলস বুর্জোয়াদের দাম্পত্যজীবনকে পতিতাবৃত্তি মনে করলেও প্রলেতারিয়েতদের সম্পর্কে তাঁর উঁচু ধারণা ছিলো; তিনি মনে করেছেন তাদের মধ্যে স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক সুস্থ হ’তে পারে। কিন্তু এটা এক সাম্যবাদী ভ্ৰান্তি। প্রলেতারিয়েতদের স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক আরো অসুস্থ; তা একেবারেই শস্তা পতিতাবৃত্তি। পতিতার খদ্দের হিশেবে প্রলেতারিয়েতের থেকে বুর্জোয়া উৎকৃষ্ট।