আগে নারী ছিলো গৃহের প্রধান; মাতৃ-অধিকার উচ্ছেদের পর পুরুষ দখল করে গৃহের কর্তৃত্ব। পুরুষ নারীকে করে নিজের দাসী, শৃঙ্খলিত, লালসার শিকার ও সন্তান (বিশেষ ক’রে পুত্র) উৎপাদনের যন্ত্র। দেখা দেয় পিতৃপ্রধান একপতিপত্নী পরিবার। আরো দুটি প্রথা ছিলো বিয়ের, এর একটি এখনো টিকে আছে মুসলমানদের মধ্যে। একটি বহুপত্নীত্ব ও অন্যটি বহুস্বামীত্ব। বহুপত্নীত্ব হচ্ছে সম্ভোগের চরম রূপ। ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে ও তিব্বতে বহুস্বামীত্বও এক সময় ছিলো, হয়তো এখনো আছে। এখন চলছে, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, একপতিপত্নী প্রথা; কিন্তু একপতিপত্নী প্রথার সূচনা হয় কখন, এবং কাদের উদ্যোগে? বাখোফেন বলেছেন, তার কথিত ‘হেটায়ারিজম’ থেকে চালু হয়েছিলো একপতিপত্নীপ্ৰথা নারীদেরই চেষ্টায়। তাঁর মতকে এঙ্গেলস বলেছেন ‘সম্পূর্ণ নির্ভুল’। এ-বদলের কারণ ব্যাখ্যা ক’রে এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২১০) বলেছেন যে আর্থনীতিক বিকাশের ফলে আদিম সাম্যতন্ত্রী ব্যবস্থার ঘটে অবনতি, আগের যৌনসম্পর্কগুলো আরণ্যক চরিত্র হারিয়ে নারীদের কাছে মনে হতে থাকে হীন ও পীড়নমূলক, তাই ‘আগ্রহের সঙ্গে পরিত্রাণ হিসাবে তারা অবশ্য পাতিব্ৰত্যের অধিকার, একটি পুরুষের সঙ্গে অস্থায়ী বা স্থায়ী বিবাহ চেয়ে থাকবে।‘ এঙ্গেলস মনে করেন এ-অগ্রগতি পুরুষ চাইতে পারে না, কেননা পুরুষ আজও পর্যন্ত স্বপ্নেও কখনও আসল সমষ্টি-বিবাহের সুবিধা ছাড়তে চায় নি।‘ নারীরাই চেয়েছিলো পাতিব্ৰত্য, বহুযৌনসম্পর্ক নারীদের কাছে মনে হয়েছিলো পীড়াদায়ক, এবং তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে নারীরা চেয়েছিলো একপতির পবিত্ৰ শয্যায় সতীত্বের অধিকার? সমষ্টি বিয়ে পুরুষের জন্যে সুবিধাজনক, নারীদের জন্যে অসুবিধাজনক? মিলেট (১৯৬৯, ১১৬) এঙ্গেলসের সিদ্ধান্তে দেখেছেন ‘অ্যাবসারডিটি’; কেননা এঙ্গেলস ধরে নিয়েছেন যে নারীরা কাম অপছন্দ করে। হাজার হাজার বছর ধরে পুর্বপশ্চিমের ঋষিরা রটিয়েছেন নারীরা কামচণ্ডালী, ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণ (২৩:৩২) বলেছর ‘পুরুষের থেকে নারীদের কাম আটগুণ’, সন্তরা বলেছেন জরায়ুর ক্ষুধা আগুনের মতোই অশেষ ; আর এঙ্গেলস ধ’রে নিয়েছেন কাম নারীদের কাছে পীড়াদায়ক, অপ্ৰিয়। সঙ্গমকে তিনি হয়তো মনে করেছিলেন নারীর একধরনের রাজনীতিক পরাজয়, কেননা নারী যেনো তাতে আত্মসমৰ্পণ করে পুরুষের কাছে; এবং তার ভিক্টোরীয় মানসিকতাও কাজ করেছিলো এর পেছনে। ওই সময়ে এমন একটি ধারণা তৈরি, প্রচার ও জনপ্রিয় ক’রে তোলা হয়েছিলো যে নারী কামকে ঘেন্না করে, কাম নারীর প্রিয় নয়। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ভিক্টোরীয় সংস্কৃতি নারীকে কামবোধহীন ক’রে তুলেছিলো, শীতল নারীকেই তারা মনে করতো সতী; তাই সে-সময় নারীরা শীতল হয়ে উঠেছিলো; কিন্তু কাম নারীদের কাছে অপ্ৰিয় নয়। নারীদের কামপ্রবলতা সম্পর্কে প্রাচীন উপাখ্যানের শেষ নেই : মহাভারত-এ একটি উপাখ্যান রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে পুরুষদের থেকে নারীরাই সঙ্গম উপভোগ করে বেশি। রাজর্ষি ভঙ্গাসন ইন্দ্রের ক্ৰোধে নারীতে পরিণত হয়, এবং এক তাপসের ঔরষে নিজের গর্ভে একশো পুত্র জন্ম দেয়। পরে ইন্দ্র তাকে পুরুষত্ব ও নারীত্বের মধ্যে একটি বেছে নিতে বললে সে নারীই থাকতে চায়। কারণ হিশেষে সে বলে, ‘স্ত্রীপুরুষের সংযোগকালে স্ত্রীরই অধিক সুখ হয়।‘ ভঙ্গাসনের মতো নারীপুরুষ দু-রূপেই অভিজ্ঞতা অর্জন এখন অসম্ভব, কিন্তু মিলনের সময় নারীর আচরণ দেখে মনে হতে পারে কাম উদ্ভাবিতই হয়েছিলো নারীর জন্যে। কাম পুরুষের একটি প্রত্যঙ্গের, আর নারীর সমগ্র শরীর ও চৈতনার ব্যাপার। আধুনিক গবেষণা তাই প্রমাণ করেছে।
আধুনিক গবেষণা দেখিয়েছে সহজাত ও জৈবিকভাবে নারী পুরুষের থেকে অনেক বেশি উপভোগ করে কাম। পৌনপুনিকতায় ও পুলকানুভূতিতে নারী অনেক বেশি সমর্থ পুরুষের থেকে। মাস্টারস ও জনসন সাড়াজাগানো ‘মানুষের যৌন সাড়া’ (১৯৬৬) গ্রন্থে দেখিয়েছেন নারী খুব দ্রুত একের পর এক পুলক অনুভব করতে পারে, যা পুরুষ কখনো পারে না। নারীর পুলক সম্পর্কে ধারণাও বদলে গেছে একালে। আগে শুধু রন্ধটিকেই সুখের খনি মনে করা হতো; কিন্তু নারীর আসল সুখের বেদি ভগাঙ্কুর। মানুষের অন্য কামাঙ্গগুলোর আরো কাজ আছে, কিন্তু নারীরই শুধু রয়েছে একটি বিশেষ প্রত্যঙ্গ যার একমাত্র কাজ যৌনসুখ অনুভব। সেটি ভগাঙ্কুর। পুরুষের এমন কোনো প্রত্যঙ্গ নেই। পুরুষের যৌনশক্তি সীমিত, নারীর অমিত, তাতে শুধু বাধা দিতে পারে শারীরিক ক্লান্তি বা মানসিক অবস্থা। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা নারীকে ও তার কামকে দমন ক’রে রেখেছে নানা বিধিনিষেধে; এবং পুরুষের কামকে ক’রে তুলেছে নিবৃত্তিহীন। পুরুষতন্ত্র পুরুষের কামশক্তির ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করেছে বহুবিবাহ ও দ্বৈতমানের সুযোগ। এটা জৈব সত্যের সম্পূর্ণ অপলাপ। পুরুষতন্ত্র ভোগে স্ববিরোধিতায়ও : পুরুষতন্ত্র নারীকে কামসামগ্ৰীতে পরিণত করতে চায়, আবার চায় যে নারী হবে কামবিমুখ। মুসলমান দেশগুলোতে এটা প্ৰবল; ওই দেশের পুরুষেরা চায় স্বামীদের শয্যায় নারীরা হবে মেরেলিন মনরো, শয্যার বাইরে হবে সতীসাধ্বী বিবি। এঙ্গেলসের ধারণা ঠিক নয় যে নারীরাই চেয়েছিলো একপতির অধীনে পতিব্ৰতা হয়ে থাকতে, কেননা কাম তাদের কাছে পীড়াদায়ক। পুরুষই চেয়েছিলো, তাই এটা হয়েছে; যদি নারী চাইতো আর পুরুষ না চাইতো, তাহলে কখনো এটা ঘটতো না। পুরুষ নারীকে ক’রে তুলেছিলো তাদের শ্ৰেষ্ঠ সম্পত্তি, আর ওই সম্পত্তিতে ভাগ বসাক অন্য কেউ, এটা তারা চায় নি। তারা নিজেদের জন্যে রেখেছে বহুবিবাহ, বা বহুনারীসংসর্গের সুযোগ্য; আর নারীকে ক’রে রেখেছে একজনের একান্ত ভোগ্যবস্তু। নারী বহু কাল ধ’রে বাধ্য হয়ে যুগিয়ে আসছে পুরুষের কামতৃপ্তি এবং পশুর মতো প্রসব করে আসছে মনুষ্যশাবক।