ক্রমে ক্রমে সম্পদ বাড়তে থাকে, আর সম্পদই শত্রু হয়ে দেখা দেয় নারীদের। পুরুষ যখন জমির মালিক হয়, সে তখন নারীর মালিকানাও দাবি করে। জমি আর নারী পুরুষের কাছে এক। আরণ্যপর্ব থেকে মানুষ যখন পৌঁছোয় কৃষিপর্বে তখন সম্পদশালী হয়ে ওঠে বিভিন্ন গোত্র। একসময় ওই সম্পদ অধিকারে চলে আসে গোত্রপতিদের; তারা হয়ে ওঠে সম্পদশালী। আগে, মাতৃ-অধিকার অনুযায়ী, গোত্রের কেউ মারা গেলে তার সম্পত্তি পেতো গোত্রভুক্তরা। সম্পদ যতো বাড়তে থাকে পরিবারে নারীদের থেকে গুরুত্ব বাড়তে থাকে পুরুষদের, এবং পুরুষেরা উদ্যোগ নেয় উত্তরাধিকারের সূত্র বদলানোর। পুরুষ মাতৃধারার প্রথা ভেঙে সৃষ্টি করে পিতৃধারার প্রথা। এটা এক বিপ্লব, কিন্তু এ-বিপ্লবে কোনো রক্তপাত ঘটে নি; নীরবেই সম্পন্ন হয়। পুরুষের অভ্যুত্থান। স্থির হয়। পুরুষের সন্তানসন্ততি হবে তার গোত্রভুক্ত, নারীর সন্তানেরা বাদ পড়বে গোত্র থেকে, অন্তর্ভুক্ত হবে পিতার গোত্রের। এভাবে উচ্ছেদ হয় মায়েদের দিক দিয়ে বংশপরম্পরার হিশেবে ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার; তার স্থানে আসে পিতার দিক থেকে বংশপরম্পরার হিশেবে ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার। ঠিক কখন এ-বিপ্লব ঘটেছিলো, অভ্যুত্থান ঘটেছিলো পুরুষের, এবং কীভাবে ঘটেছিলো, তা আজ বলার উপায় নেই, কিন্তু এটা সত্য যে মানুষ প্ৰজাতির মধ্যে পুংলিঙ্গের উত্থানে অধিকার হারিয়েছিলো স্ত্রীলিঙ্গ। মাতৃ-অধিকারের উচ্ছেদকে এঙ্গেলস বলেছেন ‘স্ত্রীজাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়’, যার ভার এখনো বইছে নারী। সত্যিই কি একসময় একটা আশ্চর্য সোনালি যুগ ছিলো নারীদের, যা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো পুরুষের অভ্যুত্থানে? বাখোফেন এতে বিশ্বাস করেন, তার অনুসরণে এতে বিশ্বাস করেন এঙ্গেলস; কিন্তু দ্য বোভোয়ার মনে করেন নারীদের ওই সোনালি যুগ একটি সুন্দর কিংবদন্তি। তার মতে সমাজ সব সময়ই পুরুষের, রাজনীতিক শক্তিও সব সময় ছিলো ও আছে পুরুষের মুঠোতে। তবে বাখোফেন নারীর সোনালি দিনের, পুরুষতন্ত্রের অভ্যুত্থানের যে কথা বলেছেন, তা তাঁর কল্পনা নয়; তিনি পুরুষের অভ্যুত্থানের কিছু চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন পুরাণে ও সাহিত্যে।
কখন ঘটে এ-অভুত্থান? সম্ভবত এটা ঘটে যখন জানা হয়ে যায় পিতৃত্বের রহস্য। আগে মনে করা হতো নারীদের গর্ভে দৈবপ্রক্রিয়ায় পুনরায় শিশু হয়ে জন্ম নেয় পূৰ্বপুরুষেরা; কিন্তু পিতৃত্বের রহস্য যখন জানা হয়, যখন পুরুষ বুঝতে পারে সন্তান জন্ম দেয়ায় রয়েছে তার ভূমিকা, তখন পুরুষ প্রজননে নারীর ভূমিকাকে অস্বীকার ক’রে নিজের ভূমিকাকেই গুরুত্বপূর্ণ ব’লে ঘোষণা করে। পিতৃত্বের রহস্যটি যখন জানা হয়, তখনই ঘটে পুরুষতান্ত্রিক বিপ্লব। বাখোফেন এর পরিচয় দেখতে পেয়েছেন এস্কিলুসের অরেন্সতেইয়া ত্ৰিনাটকে। এ-ত্রিনাটকের তৃতীয়টির নাম অয়মেনিদেস [সুভাষিত অর্থ: দয়াবতী দেবীগণ, আসলে বোঝায় প্রতিহিংসার দেবীগণ], যাতে রূপায়িত হয়েছে জয়ী পিতৃতন্ত্র ও পরাজিত মাতৃতন্ত্রের শেষ রাজনীতিক সংঘর্ষ। ট্রয়ের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছে বিজয়ী সেনাপতি আগামেমনন, সাথে নিয়ে এসেছে অনেক নারীর মধ্যে ট্রয়ের রাজকন্যা কাসান্দ্ৰাকে, ধর্ষণেধর্ষণে যে পাগল হয়ে গেছে। ফেরার পর এ বিজয়ী বীরকে হত্যা করে তার স্ত্রী ক্লাইতেমনোন্ত্রা। হত্যার পেছনে রয়েছে দুটি কারণ; স্বামীর দশ বছরের অনুপস্থিতির সময় সে একটি দায়িত পেয়েছে, এবং সে তার কন্যা ইফিজিনিয়ার হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায়। ট্রয়যাত্রার আগে আগামেমনন কন্যা ইফিজিনিয়াকে একিলিসের সাথে বিয়ে দেয়ার কথা বলে নিয়ে বলি দেয় দেবতার উদ্দেশে, যাতে দেবতার বরে অনুকূল বায়ুতে সে যেতে পারে ট্রয়ে। পরে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে অরেসতেস খুন করে মা ক্লাইতেমনোন্ত্রাকে। কিন্তু মাকে খুন ক’রে অরেসতেস রুষ্ট করে প্রতিহিংসার দেবীদেব, যারা তাকে তাড়িয়ে ফেরে শহর থেকে শহরে।
প্রতিহিংসার দেবী কারা? তারা আর কেউ নয়, তারা মাতৃতন্ত্র বা মাতৃ-অধিকারের পরাভূত শক্তিরাশি, যারা এখন পরিণত হয়েছে কলহপরায়ণ নারীতে। তারা যখন চিৎকার ক’রে অরেসতেসের শাস্তি চায়, তখন তাদের চিৎকারে শোনা যায় মাতৃ-অধিকারের শেষ দাবি। অরেসতেস তাদের জানায় তার কোনো দোষ নেই, অ্যাপোলোর নির্দেশেই সে মাতৃহত্যা করেছে। দৈববাণীর দেবতা এমন নির্দেশ দেবে, এটা তাদের বিশ্বাস হয় না; তাই তারা বিচারের জন্যে অ্যাথেনাকে মধ্যস্থ মানে অরেসতেস। জানতে চায় তারা কেনো স্বামীঘাতক ক্লাইতেমনোস্ত্ৰকে তাড়া করে নি? তারা উত্তর দেয় : ‘যে-পুরুষকে সে করেছে হত্যা তার সাথে ছিলো না তার রক্তের সম্পর্ক।’ এতে প্রকাশ পায় মাতৃ-অধিকারের ন্যায়। অরেসতেস প্রশ্ন করে : ‘কিন্তু আমি কি আমার মায়ের?’ এ-প্রশ্নে ক্ষুব্ধ হয় দেবীরা; কিন্তু অ্যাপোলো সত্যকে অস্বীকার ক’রে, পিতৃতান্ত্রিক দাপটে, জানায়, ‘মা ছাড়াও পিতা পারে জন্ম দিতে’। সে প্রমাণ হিশেবে দাঁড় করায় অ্যাথেনাকে, যার জন্ম হয়েছিলো পিতা জিউসের মাথা থেকে। অ্যাথেনা উঁচু গলায় ঘোষণা করে পুরুষতন্ত্রের জয়। প্রতিহিংসার দেবীরা ‘হে মাতা, হে অন্ধকার’ ব’লে কান্নায় ভেঙে পড়ে। হেরে যায় আগের উর্বরতার দেবীরা, সেখানে দেখা দেয় পুরুষ দেবতারা; মাতৃতন্ত্রকে উচ্ছেদ ক’রে প্রতিষ্ঠা পায় পিতৃতন্ত্র। পুরুষের জয় ঘোষিত হয় দিকেদিকে, এবং হাজার হাজার বছরে কেউ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নি। নারী হয়ে থাকে মানুষপ্রজাতির পরাভূত লিঙ্গ।